কমলা রুদ্ধনিশ্বাসে একান্ত আগ্রহের সহিত জিজ্ঞাসা করিল, “তার পরে?”
রমেশ কহিল, “এই পর্যন্তই জানি, তার পরে আর জানি না। তুমিই বলো দেখি, তার পরে কী।”
কমলা। না না, সে হইবে না, তার পরে কী আমাকে বলো।
রমেশ। সত্য বলিতেছি, যে গ্রন্থ হইতে এই গল্প পাইয়াছি তাহা এখনো সম্পূর্ণ প্রকাশিত হয় নাই–শেষের অধ্যায়গুলি কবে বাহির হইবে কে জানে।
কমলা অত্যন্ত রাগ করিয়া কহিল, “যাও, তুমি ভারি দুষ্ট! তোমার ভারি অন্যায়।”
রমেশ। যিনি বই লিখিতেছেন তাঁর সঙ্গে রাগারাগি করো। তোমাকে আমি কেবল এই প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করিতেছি, চন্দ্রাকে লইয়া চেৎসিং কী করিবে?
কমলা তখন নদীর দিকে চাহিয়া ভাবিতে লাগিল; অনেকক্ষণ পরে কহিল, “আমি জানি না, সে কী করিবে–আমি তো ভাবিয়া উঠিতে পারি না।”
রমেশ কিছুক্ষণ স্তব্ধ হইয়া রহিল; কহিল, “চেৎসিং কি সকল কথা চন্দ্রাকে প্রকাশ করিয়া বলিবে?”
কমলা কহিল, “তুমি বেশ যা হোক, না বলিয়া বুঝি সমস্ত গোলমাল করিয়া রাখিবে? সে যে বড়ো বিশ্রী। সমস্ত স্পষ্ট হওয়া চাই তো।”
রমেশ যন্ত্রের মতো কহিল, “তা তো চাই।”
রমেশ কিছুক্ষণ পরে কহিল, “আচ্ছা কমল, যদি–”
কমলা। যদি কী?
রমেশ। মনে করো, আমিই যদি সত্য চেৎসিং হই, আর তুমি যদি চন্দ্রা হও–
কমলা বলিয়া উঠিল, “তুমি অমন কথা আমাকে বলিয়ো না; সত্য বলিতেছি, আমার ভালো লাগে না।”
রমেশ। না, তোমাকে বলিতেই হইবে, তাহা হইলে আমারই বা কী কর্তব্য আর তোমারই বা কর্তব্য কী? কমলা এ কথার কোনো উত্তর না করিয়া চৌকি ছাড়িয়া দ্রুতপদে চলিয়া গেল। দেখিল, উমেশ তাহাদের
কামরার বাহিরে চুপ করিয়া বসিয়া নদীর দিকে চাহিয়া আছে। জিজ্ঞাসা করিল, “উমেশ, তুই কখনো ভূত দেখিয়াছিস?”
উমেশ কহিল, “দেখিয়াছি মা।”
শুনিয়া কমলা অনতিদূর হইতে একটা বেতের মোড়া টানিয়া আনিয়া বসিল; কহিল, “কিরকম ভূত
দেখিয়াছিলি বল্।”
কমলা বিরক্ত হইয়া চলিয়া গেলে রমেশ তাহাকে ফিরিয়া ডাকিল না। চন্দ্রখণ্ড তাহার চোখের সম্মুখে ঘন বাঁশবনের অন্তরালে অদৃশ্য হইয়া গেল। ডেকের উপরকার আলো নিবাইয়া দিয়া তখন সারেং-খালাসিরা জাহাজের নীচের তলায় আহার ও বিশ্রামের চেষ্টায় গেছে। প্রথম-দ্বিতীয় শ্রেণীতে যাত্রী কেহই ছিল না। তৃতীয় শ্রেণীর অধিকাংশ যাত্রী রন্ধনাদির ব্যবস্থা করিতে জল ভাঙিয়া ডাঙায় নামিয়া গেছে। তীরে তিমিরাচ্ছন্ন ঝোপঝাপ-গাছপালার ফাঁকে ফাঁকে অদূরবর্তী বাজারের আলো দেখা যাইতেছে। পরিপূর্ণ নদীর খরস্রোত নোঙরের লোহার শিকলে ঝংকার দিয়া চলিয়াছে এবং থাকিয়া থাকিয়া জাহ্নবীর স্ফীত নাড়ির কম্পবেগ স্টীমারকে স্পন্দিত করিয়া তুলিতেছে।
নৌকাডুবি ২৬
- Details
- Rabindranath Tagore ।। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
- রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর উপন্যাস
- Category: নৌকাডুবি
- Read Time: 1 min
- Hits: 171