আগামী শনিবারে কমলাকে বিদ্যালয় হইতে লইয়া আসিতে হইবে! আগামী রবিবারে রমেশের বিবাহ!
“রমেশবাবু, আমাকে মাপ করিতে হইবে” এই বলিয়া অক্ষয় ঘরের মধ্যে প্রবেশ করিল। কহিল, “এমন একটা সামান্য ঠা ঠাট্টায় আপনি যে এত রাগ করিবেন, তাহা আগে জানিলে আমি ও কথা তুলিতাম না। ঠা ঠাট্টার মধ্যে কিছু সত্য থাকিলেই লোকে চটিয়া ওঠে, কিন্তু যাহা একেবারে অমূলক তাহা লইয়া আপনি সকলের সাক্ষাতে এত রাগারাগি করিলেন কেন? অন্নদাবাবু তো কাল হইতে আমাকে ভর্ৎসনা করিতেছেন-হেমনলিনী আমার সঙ্গে কথা বন্ধ করিয়াছেন। আজ সকালে তাঁহাদের ওখানে গিয়াছিলাম, তিনি ঘর ছাড়িয়া চলিয়াই গেলেন। আমি এমন কী অপরাধ করিয়াছিলাম বলুন দেখি।”
রমেশ কহিল, “এ-সমস্ত বিচার যথাসময়ে হইবে। এখন আমাকে মাপ করিবেন–আমার বিশেষ একটা প্রয়োজন আছে।” অক্ষয়। রোশনচৌকির বায়না দিতে চলিয়াছেন বুঝি? এ দিকে সময়সংক্ষেপ। আমি আপনার শুভকর্মে বাধা দিব না, চলিলাম।
অক্ষয় চলিয়া গেলে রমেশ অন্নদাবাবুর বাসায় গিয়া উপস্থিত হইল। ঘরে ঢুকিতেই হেমনলিনীর সহিত তাহার সাক্ষাৎ হইল। আজ রমেশ সকাল-সকাল আসিবে, ইহা হেমনলিনী নিশ্চয় ঠিক করিয়া প্রস্তুত হইয়া বসিয়া ছিল। তাহার সেলাইয়ের ব্যাপারটি ভাঁজ করিয়া রুমালে বাঁধিয়া টেবিলের উপরে রাখিয়া দিয়াছিল। পাশে হারমোনিয়ম-যন্ত্রটি ছিল। আজ খানিকটা সংগীত-আলোচনা হইতে পারিবে এইরূপ তাহার আশা ছিল, তা ছাড়া
অব্যক্ত সংগীত তো আছেই।
রমেশ ঘরে ঢুকিতেই হেমনলিনীর মুখে একটি উজ্জ্বল-কোমল আভা পড়িল। কিন্তু সে আভা মুহূর্তেই মলান হইয়া গেল যখন রমেশ আর-কোনো কথা না বলিয়া প্রথমেই জিজ্ঞাসা করিল, “অন্নদাবাবু কোথায়?”
হেমনলিনী উত্তর করিল, “বাবা তাঁহার বসিবার ঘরে আছেন। কেন? তাঁহাকে কি এখনি প্রয়োজন আছে? তিনি তো সেই চা খাইবার সময় নামিয়া আসিবেন।”
রমেশ। না, আমার বিশেষ প্রয়োজন আছে। আর বিলম্ব করা উচিত হইবে না।
হেমনলিনী। তবে যান, তিনি ঘরেই আছেন।
রমেশ চলিয়া গেল। প্রয়োজন আছে! সংসারে প্রয়োজনেরই কেবল সবুর সয় না! আর ভালোবাসাকেই দ্বারের বাহিরে অবকাশ প্রতীক্ষা করিয়া বসিয়া থাকিতে হয়।
শরতের এই অমলান দিন যেন নিশ্বাস ফেলিয়া আপন আনন্দ-ভাণ্ডারের সোনার সিংহদ্বারটি বন্ধ করিয়া দিল। হেমনলিনী হারমোনিয়মের নিকট হইতে চৌকি সরাইয়া লইয়া টেবিলের কাছে বসিয়া একমনে সেলাই করিতে প্রবৃত্ত হইল। ছুঁচ ফুটিতে লাগিল কেবল বাহিরে নহে, ভিতরেও। রমেশের প্রয়োজনও শীঘ্র শেষ হইল না। প্রয়োজন রাজার মতো আপনার পুরা সময় লয়–আর ভালোবাসা কাঙাল!

<

Rabindranath Tagore ।। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর