কত শতসহস্র লোক ভালোমন্দ কত কী কাজে লিপ্ত রহিয়াছে, সংসারচক্র চলিতেছে–হেমনলিনী তাহার বিচারভার লয় নাই। রমেশের কথা হেমনলিনী মনেও আনিতে ইচ্ছা করে না। মাঝে মাঝে আত্মঘাতিনী কমলার কথা কল্পনা করিয়া তাহার শরীর শিহরিয়া উঠে; তাহার মনে হইতে থাকে, ‘এই হতভাগিনীর আত্মহত্যার সঙ্গে আমার কি কোনো সংস্রব আছে?’ তখন লজ্জায়, ঘৃণায়, করুণায় তাহার সমস্ত হৃদয় মথিত হইতে থাকে। সে জোড়হাত করিয়া বলে, ‘হে ঈশ্বর, আমি তো অপরাধ করি নাই, তবে আমি কেন এমন করিয়া জড়িত হইলাম? আমার এ বন্ধন মোচন করো, একেবারে ছিন্ন করিয়া দাও। আমি আর কিছুই চাই না, আমাকে তোমার এই জগতে সহজভাবে বাঁচিয়া থাকিতে দাও।’
রমেশ ও কমলার ঘটনা শুনিয়া হেমনলিনী কী মনে করিতেছে, তাহা জানিবার জন্য অন্নদাবাবু উৎসুক হইয়া আছেন, অথচ কথাটা স্পষ্ট করিয়া পাড়িতে তাঁহার সাহস হইতেছে না। হেমনলিনী বারান্দায় চুপ করিয়া বসিয়া সেলাই করিতেছিল, সেখানে এক-একবার গিয়া হেমনলিনীর চিন্তারত মুখের দিকে চাহিয়া তিনি ফিরিয়া আসিয়াছেন।
সন্ধ্যার সময় ডাক্তারের উপদেশমত অন্নদাবাবুকে জারকচূর্ণমিশ্রিত দুগ্ধ পান করাইয়া হেমনলিনী তাঁহার কাছে বসিল। অন্নদাবাবু কহিলেন, “আলোটা চোখের সামনে হইতে সরাইয়া দাও।”
ঘর একটু অন্ধকার হইলে অন্নদাবাবু কহিলেন, “সকালবেলায় যে বৃদ্ধটি আসিয়া-ছিলেন তাঁহাকে দেখিয়া বেশ সরল বোধ হইল।”
হেমনলিনী এই প্রসঙ্গ লইয়া কোনো কথা কহিল না, চুপ করিয়া রহিল। অন্নদাবাবু আর অধিক ভূমিকা বানাইতে পারিলেন না। তিনি কহিলেন, “রমেশের ব্যাপার শুনিয়া আমি কিন্তু আশ্চর্য হইয়া গেছি–লোকে তাহার সম্বন্ধে অনেক কথা বলিয়াছে, আমি আজ পর্যন্ত তাহা বিশ্বাস করি নাই, কিন্তু আর তো–”
হেমনলিনী কাতরকণ্ঠে কহিল, “বাবা, ও-সকল কথার আলোচনা থাক্‌।”
অন্নদাবাবু কহিলেন, “মা, আলোচনা করিতে তো ইচ্ছা করেই না। কিন্তু বিধির বিপাকে অকসমাৎ এক-একজন লোকের সঙ্গে আমাদের সুখদুঃখ জড়িত হইয়া যায়, তখন তাহার কোনো আচরণকে আর উপেক্ষা করিবার জো থাকে না।”
হেমনলিনী সবেগে বলিয়া উঠিল, “না না, সুখদুঃখের গ্রনিথ অমন করিয়া যেখানে সেখানে কেন জড়িত হইতে দিব। বাবা, আমি বেশ আছি, আমার জন্য বৃথা উদ্‌বিগ্ন হইয়া আমাকে লজ্জা দিয়ো না।”
অন্নদাবাবু কহিলেন, “মা হেম, আমার বয়স হইয়াছে, এখন তোমার একটা স্থিতি না করিয়া তো আমার মন স্থির হইতে পারে না। তোমাকে এমন তপস্বিনীর মতো কি আমি রাখিয়া যাইতে পারি?”
হেমনলিনী চুপ করিয়া রহিল। অন্নদাবাবু কহিলেন, “দেখো মা, পৃথিবীতে একটা আশা চূর্ণ হইল বলিয়াই যে আর-সমস্ত দুর্মূল্য জিনিসকে অগ্রাহ্য করিতে হইবে, এমন কোনো কথা নাই। তোমার জীবন কিসে সুখী হইবে, সার্থক হইবে, আজ হয়তো মনের ক্ষোভে তাহা তুমি না জানিতেও পার, কিন্তু আমি নিয়ত তোমার মঙ্গলচিন্তা করি–আমি জানি তোমার কিসে সুখ, কিসে মঙ্গল–আমার প্রস্তাবটাকে একেবারে উপেক্ষা করিয়ো না।”

<

Rabindranath Tagore ।। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর