নলিনাক্ষ। ঢেলা যে নানা রকমের আছে। কোনোটা বা স্পর্শ করে, কোনোটা বা চিহ্নিত করিয়া যায়। যদি কেহ বলে, লোকটা পাগলামি করিতেছে, ছেলেমানুষি করিতেছে, তাহাতে কোনো ক্ষতি করে না; কিন্তু যখন বলে, লোকটা সাধুগিরি-সাধকগিরি করিতেছে, গুরু হইয়া উঠিয়া চেলা-সংগ্রহের চেষ্টায় আছে, তখন সে কথাটা হাসিয়া উড়াইবার চেষ্টা করিতে গেলে যে পরিমাণ হাসির দরকার হয় সে পরিমাণ অপর্যাপ্ত হাসি জোগায় না।
যোগেন্দ্র। কিন্তু আবার বলিতেছি, আমার উপরে রাগ করিবেন না নলিনবাবু। আপনি ছাদে উঠিয়া যাহা খুশি করুন, আমি তাহাতে আপত্তি করিবার কে? আমার বক্তব্য কেবল এই যে, সাধারণের সীমানার মধ্যে নিজেকে ধরিয়া রাখিলে কোনো কথা থাকে না। সকলের যেরকম চলিতেছে আমার তেমনি চলিয়া গেলেই যথেষ্ট; তার বেশি চলিতে গেলেই লোকের ভিড় জমিয়া যায়। তাহারা গালি দিক বা ভক্তি করুক, তাহাতে কিছু আসে যায় না; কিন্তু জীবনটা এইরকম ভিড়ের মধ্যে কাটানো কি আরামের?
নলিনাক্ষ। যোগেন্দ্রবাবু, যান কোথায়? আমাকে আমার ছাদের উপর হইতে একেবারে সর্বসাধারণের শানবোঁধানো এক তলার মেঝের উপর সবলে হঠাৎ উত্তীর্ণ করিয়া দিয়া পালাইলে চলিবে কেন?
যোগেন্দ্র। আজকের মতো আমার পক্ষে যথেষ্ট হইয়াছে, আর নয়। একটু ঘুরিয়া আসি গে।
যোগেন্দ্র চলিয়া গেলে পর হেমনলিনী মুখ নত করিয়া টেবিল-ঢাকার ঝালরগুলির প্রতি অকারণে উপদ্রব করিতে লাগিল। সে সময়ে অনুসন্ধান করিলে তাহার চক্ষু-পল্লবের প্রান্তে একটা আর্দ্রতার লক্ষণও দেখা যাইত।
হেমনলিনী দিনে দিনে নলিনাক্ষের সহিত আলাপ করিতে করিতে আপনার অন্তরের দৈন্য দেখিতে পাইল এবং নলিনাক্ষের পথ অনুসরণ করিবার জন্য ব্যাকুলভাবে ব্যগ্র হইয়া উঠিল। অত্যন্ত দুঃখের সময় যখন সে অন্তরে-বাহিরে কোনো অবলম্বন খুঁজিয়া পাইতেছিল না, তখনই নলিনাক্ষ বিশ্বকে তাহার সম্মুখে যেন নূতন করিয়া উদ্ঘাটিত করিল। ব্রহ্মচারিণীর মতো একটা নিয়মপালনের জন্য তাহার মন কিছুদিন হইতে উৎসুক ছিল–কারণ, নিয়ম মনের পক্ষে একটা দৃঢ় অবলম্বন; শুধু তাহাই নহে, শোক কেবলমাত্র মনের ভাব আকারে টিঁকিতে চায় না, সে বাহিরেও একটা কোনো কৃচ্ছ্রসাধনের মধ্যে আপনাকে সত্য করিয়া তুলিতে চেষ্টা করে। এ পর্যন্ত হেমনলিনী সেরূপ কিছু করিতে পারে নাই, লোকচক্ষুপাতের সংকোচে বেদনাকে সে অত্যন্ত গোপনে আপনার মনের মধ্যেই পালন করিয়া আসিয়াছে। নলিনাক্ষের সাধনপ্রণালীর অনুসরণ করিয়া আজ যখন সে শুচি আচার ও নিরামিষ আহার গ্রহণ করিল তখন তাহার মন বড়ো তৃপ্তিলাভ করিল। নিজের শয়নঘরের মেজে হইতে মাদুর ও কার্পেট তুলিয়া ফেলিয়া বিছানাটি এক ধারে পর্দার দ্বারা আড়াল করিল; সে ঘরে আর-কোনো জিনিস রাখিল না। সেই মেজে প্রত্যহ হেমনলিনী স্বহস্তে জল ঢালিয়া পরিষ্কার করিত-একটি রেকাবিতে কয়েকটি ফুল থাকিত; স্নানান্তে শুবিস্ত্র পরিয়া সেইখানে মেজের উপরে হেমনলিনী বসিত; সমস্ত মুক্ত বাতায়ন দিয়া ঘরের মধ্যে অবারিত আলোক প্রবেশ করিত এবং সেই আলোকের দ্বারা, আকাশের দ্বারা, বায়ুর দ্বারা সে আপনার অন্তঃকরণকে অভিষিক্ত করিয়া লইত। অন্নদাবাবু সম্পূর্ণভাবে হেমনলিনীর সহিত যোগ দিতে পারিতেন না; কিন্তু নিয়মপালনের দ্বারা হেমনলিনীর মুখে যে-একটি পরিতৃপ্তির দীপ্তি প্রকাশ পাইত তাহা দেখিয়া বৃদ্ধের মন সিনগ্ধ হইয়া যাইত। এখন হইতে নলিনাক্ষ আসিলে হেমনলিনীর এই ঘরেই মেজের উপরে বসিয়া তাঁহাদের তিন জনের মধ্যে আলোচনা চলিত।
যোগেন্দ্র একেবারে বিদ্রোহী হইয়া উঠিল–”এ-সমস্ত কী হইতেছে? তোমরা যে সকলে মিলিয়া বাড়িটাকে ভয়ংকর পবিত্র করিয়া তুলিলে–আমার মতো লোকের এখানে পা ফেলিবার জায়গা নাই।”
আগে হইলে যোগেন্দ্রের বিদ্রূপে হেমনলিনী অত্যন্ত কুণ্ঠিত হইয়া পড়িত–এখন অন্নদাবাবু যোগেন্দ্রের কথায় মাঝে মাঝে রাগ করিয়া উঠেন, কিন্তু হেমনলিনী নলিনাক্ষের সঙ্গে যোগ দিয়া শান্তসিনগ্ধভাবে হাস্য করে। এখন সে একটি দ্বিধাহীন নিশ্চিন্ত নির্ভর অবলম্বন করিয়াছে–এ সম্বন্ধে লজ্জা করাকেও সে দুর্বলতা বলিয়া জ্ঞান করে। লোকে তাহার এখনকার সমস্ত আচরণকে অদ্ভুত মনে করিয়া পরিহাস করিতেছে তাহা সে জানিত; কিন্তু নলিনাক্ষের প্রতি তাহার ভক্তি ও বিশ্বাস সমস্ত লোককে আচ্ছন্ন করিয়া উঠিয়াছে–এইজন্য লোকের সম্মুখে সে আর সংকুচিত হইত না।
নৌকাডুবি ৪৩ (২)
- Details
- Rabindranath Tagore ।। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
- রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর উপন্যাস
- Category: নৌকাডুবি
- Read Time: 1 min
- Hits: 167