একদিন অপরাহ্নে হেমনলিনীর সহিত একত্রে নিভৃতে চা খাইবার প্রত্যাশায় অন্নদাবাবু তাহাকে সন্ধান করিবার জন্য দোতলায় আসিলেন; দোতলায় বসিবার ঘরে তাহাকে খুঁজিয়া পাইলেন না, শুইবার ঘরেও সে নাই। বেহারাকে জিজ্ঞাসা করিয়া জানিলেন, হেমনলিনী বাহিরে কোথাও যায় নাই। তখন অত্যন্ত উৎকণ্ঠিত হইয়া অন্নদা ছাদের উপরে উঠিলেন।
তখন কলিকাতা শহরের নানা আকার ও আয়তনের বহুদূরবিস্তৃত ছাদগুলির উপরে হেমন্তের অবসন্ন রৌদ্র মলান হইয়া আসিয়াছে, দিনান্তের লঘু হাওয়াটি থাকিয়া থাকিয়া যেমন-ইচ্ছা ঘুরিয়া ফিরিয়া যাইতেছে। হেমনলিনী চিলের ছাদের প্রাচীরের ছায়ায় চুপ করিয়া বসিয়া ছিল।
অন্নদাবাবু কখন তাহার পিছনে আসিয়া দাঁড়াইলেন তাহা সে টেরও পাইল না। অবশেষে অন্নদাবাবু যখন আস্তে আস্তে তাহার পাশে আসিয়া তাহার কাঁধে হাত রাখিলেন তখন সে চমকিয়া উঠিল এবং পরক্ষণেই লজ্জায় তাহার মুখ লাল হইয়া উঠিল। হেমনলিনী তাড়াতাড়ি উঠিয়া পড়িবার পূর্বেই অন্নদাবাবু তাহার পাশে বসিলেন। একটুখানি চুপ করিয়া থাকিয়া দীর্ঘনিশ্বাস ফেলিয়া কহিলেন, “হেম, এই সময়ে তোর মা যদি থাকিতেন! আমি তোর কোনো কাজেই লাগিলাম না।”
বৃদ্ধের মুখে এই করুণ উক্তি শুনিবামাত্র হেমনলিনী যেন একটি সুগভীর মূর্ছার ভিতর হইতে তৎক্ষণাৎ জাগিয়া উঠিল। তাহার বাপের মুখের দিকে একবার চাহিয়া দেখিল। সে মুখের উপরে কী স্নেহ, কী করুণা, কী বেদনা! এই কয়দিনের মধ্যে সে মুখের কী পরিবর্তনই হইয়াছে! সংসারে হেমনলিনীকে লইয়া যে ঝড় উঠিয়াছে তাহার সমস্ত বেগ নিজের উপর লইয়া বৃদ্ধ একলা যুঝিতেছেন; কন্যার আহত হৃদয়ের কাছে বার বার ফিরিয়া ফিরিয়া আসিতেছেন; সান্ত্বনা দিবার সমস্ত চেষ্টা ব্যর্থ হইল দেখিয়া আজ হেমনলিনীর মাকে তাঁহার মনে পড়িতেছে এবং আপন অক্ষম স্নেহের অন্তঃস্তর হইতে দীর্ঘনিশ্বাস উচ্ছ্বসিত হইয়া উঠিতেছে–হঠাৎ হেমনলিনীর কাছে আজ এ-সমস্তই যেন বজ্রের আলোকে প্রকাশ পাইল। ধিক্কারের আঘাতে তাহাকে আপন শোকের পরিবেষ্টন হইতে এক মুহূর্তে বাহির করিয়া আনিল। যে পৃথিবী তাহার কাছে ছায়ার মতো বিলীন হইয়া আসিয়াছিল তাহা এখনি সত্য হইয়া ফুটিয়া উঠিল। হঠাৎ এই মুহূর্তে হেমনলিনীর মতে অত্যন্ত লজ্জার উদয় হইল। যে-সকল সমৃতির মধ্যে সে একেবারে আচ্ছন্ন হইয়া বসিয়া ছিল সে-সমস্ত বলপূর্বক আপনার চারি দিক হইতে ঝাড়িয়া ফেলিয়া সে আপনাকে মুক্তি দিল। জিজ্ঞাসা করিল, “বাবা, তোমার শরীর এখন কেমন আছে?”
শরীর! শরীরটা যে আলোচ্য বিষয় তাহা অন্নদা এ কয়দিন একেবারে ভুলিয়া গিয়াছিলেন। তিনি কহিলেন, “আমার শরীর! আমার শরীর তো বেশ আছে মা। তোমার যে-রকম চেহারা হইয়া আসিয়াছে এখন তোমার শরীরের জন্যই আমার ভাবনা। আমাদের শরীর এত বৎসর পর্যন্ত টিঁকিয়া আছে, আমাদের সহজে কিছু হয় না; তোদের এই দেহটুকু যে সেদিনকার, ভয় হয় পাছে ঘা সহিতে না পারে।”
এই বলিয়া আস্তে আস্তে তাহার পিঠে হাত বুলাইয়া দিলেন।
হেমনলিনী জিজ্ঞাসা করিল, “আচ্ছা বাবা, মা যখন মারা যান তখন আমি কত বড়ো ছিলাম?”
অন্নদা। তুই তখন তিন বছরের মেয়ে ছিলি, তখন তোর কথা ফুটিয়াছে। আমার বেশ মনে আছে, তুই
আমাকে জিজ্ঞাসা করিলি, ‘মা কোথা?’ আমি বলিলাম, ‘মা তাঁর বাবার কাছে গেছেন।’ তোর জন্মাবার পূর্বেই তোর মার বাবার মৃত্যু হইয়াছিল, তুই তাঁকে জানিতিস না। আমার কথা শুনিয়া কিছু বুঝিতে না পারিয়া আমার মুখের দিকে গম্ভীর হইয়া চাহিয়া রহিলি। খানিক ক্ষণ বাদে আমার হাত ধরিয়া তোর মার শূন্য শয়নঘরের দিকে লইয়া যাইবার জন্য টানিতে লাগিলি। তোর বিশ্বাস ছিল, আমি তোকে সেখানকার শূন্যতার ভিতর হইতে একটা সন্ধান বলিয়া দিতে পারিব। তুই জানিতিস তোর বাবা মস্ত লোক, এ কথা তোর মনেও হয় নাই যে, যেগুলো আসল কথা সেগুলোর সম্বন্ধে তোর মস্ত বাবা শিশুরই মতো অজ্ঞ ও অক্ষম। আজও সেই কথা মনে হয় যে, আমরা কত অক্ষম–ঈশ্বর বাপের মনে স্নেহ দিয়াছেন, কিন্তু কত অল্পই ক্ষমতা দিয়াছেন।

<

Rabindranath Tagore ।। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর