শৈল মলান কমলাকে একটুখানি উৎসাহিত করিয়া তুলিবার জন্য কহিল, “আজ তোমাদের বাংলায় যাইবে না।”
কমলা কহিল, “না, আর দরকার নাই।”
শৈল। তোমার ঘর-সাজানো শেষ হইয়া গেল?
কমলা। হাঁ ভাই, শেষ হইয়া গেছে।
কিছু ক্ষণ পরে আবার শৈল আসিয়া কহিল, “একটা জিনিস যদি দিই তো কী দিবি বল্?”
কমলা কহিল, “আমার কী আছে দিদি?”
শৈল। একেবারে কিছুই নাই?
কমলা। কিছুই না।
শৈল কমলার কপোলে করাঘাত করিয়া কহিল, “ইস, তাই তো! যা-কিছু ছিল সমস্ত বুঝি একজনকে সমর্পণ করিয়া দিয়াছিস? এটা কী বল্ দেখি।” বলিয়া শৈল অঞ্চলের ভিতর হইতে একটা চিঠি বাহির করিল।
লেফাফায় রমেশের হস্তাক্ষর দেখিয়া কমলার মুখ তৎক্ষণাৎ পাংশুবর্ণ হইয়া গেল–সে একটুখানি মুখ ফিরাইল।
শৈল কহিল, “ওগো, অভিমান দেখাইতে হইবে না, ঢের হইয়াছে। এ দিকে চিঠিখানা ছোঁ মারিয়া লইবার জন্য মনটার ভিতরে ধড়্ফড়্ করিতেছে–কিন্তু মুখ ফুটিয়া না চাহিলে আমি দিব না, কখনো দিব না, দেখি কত ক্ষণ পণ রাখিতে পার।”
এমন সময় উমা একটা সাবানের বাক্সে দড়ি বাঁধিয়া টানিয়া আনিয়া কহিল, “মাসি, গ-গ।”
কমলা তাড়াতাড়ি উমিকে কোলে তুলিয়া বারংবার চুমো খাইতে খাইতে শোবার ঘরে লইয়া গেল। উমি তাহার শকটচালনায় অকসমাৎ বাধাপ্রাপ্ত হইয়া চিৎকার করিতে লাগিল, কিন্তু কমলা কোনোমতেই ছাড়িল না-তাহাকে ঘরের মধ্যে লইয়া গিয়া নানাপ্রকার প্রলাপবাক্যে তাহার মনোরঞ্জন-চেষ্টায় প্রবলবেগে প্রবৃত্ত হইল।
শৈল আসিয়া কহিল, “হার মানিলাম, তোরই জিত–আমি তো পারিতাম না। ধন্যি মেয়ে! এই নে ভাই, কেন মিছে অভিশাপ কুড়াইব?”
এই বলিয়া বিছানার উপরে চিঠিখানা ফেলিয়া উমিকে কমলার হস্ত হইতে উদ্ধার করিয়া লইয়া চলিয়া গেল।
লেফাফাটা লইয়া একটুখানি নাড়াচাড়া করিয়া কমলা চিঠিখানা খুলিল; প্রথম দুই-চারি লাইনের উপরে দৃষ্টিপাত করিয়াই তাহার মুখ লাল হইয়া উঠিল। লজ্জায় সে চিঠিখানা একবার ছুঁড়িয়া ফেলিয়া দিল। প্রথম ধাক্কার এই প্রবল বিতৃষ্ণার আক্ষেপ সামলাইয়া লইয়া আবার সেই চিঠি মাটি হইতে তুলিয়া সমস্তটা সে পড়িল। সমস্তটা সে ভালো করিয়া বুঝিল কি না বুঝিল জানি না; কিন্তু তার মনে হইল যেন সে হাতে করিয়া একটা পঙ্কিল পদার্থ নাড়িতেছে। চিঠিখানা আবার সে ফেলিয়া দিল। যে ব্যক্তি তাহার স্বামী নহে তাহারই ঘর করিতে হইবে, এইজন্য এই আহ্বান! রমেশ জানিয়া শুনিয়া এতদিন পরে তাহাকে এই অপমান করিল! গাজিপুরে আসিয়া রমেশের দিকে কমলা যে তাহার হৃদয় অগ্রসর করিয়া দিয়াছিল, সে কি রমেশ বলিয়া না তাহার স্বামী বলিয়া? রমেশ তাহাই লক্ষ্য করিয়াছিল, সেইজন্যেই অনাথার প্রতি দয়া করিয়া তাহাকে আজ এই ভালোবাসার চিঠি লিখিয়াছে। মিক্রমে রমেশের কাছে যেটুকু প্রকাশ পাইয়াছিল সেটুকু কমলা আজ কেমন করিয়া ফিরাইয়া লইবে–কেমন করিয়া! এমন লজ্জা, এমন ঘৃণা কমলার অদৃষ্টে কেন ঘটিল! সে জন্মগ্রহণ করিয়া কাহার কাছে কী অপরাধ করিয়াছে? এবারে ‘ঘর’ বলিয়া একটা বীভৎস জিনিস কমলাকে গ্রাস করিতে আসিতেছে, কমলা কেমন করিয়া রক্ষা পাইবে! রমেশ যে তাহার কাছে এতবড়ো বিভীষিকা হইয়া উঠিবে, দুই দিন আগে তাহা কি কমলা স্বপ্নেও কল্পনা করিতে পারিত?
নৌকাডুবি ৩৭
- Details
- Rabindranath Tagore ।। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
- রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর উপন্যাস
- Category: নৌকাডুবি
- Read Time: 1 min
- Hits: 174