কমলার কাছে এ-সমস্ত কথা যে একেবারেই আকাশকুসুমের মতো তাহা নয়; ইহার আভাস সে কিছু-কিছু পাইয়াছে। প্রথম কয়েক মাস রমেশের সহিত প্রথম-পরিচয়ের রহস্যের মধ্যে যেন এই রকমেরই একটা রাগিণী বাজিয়া উঠিতেছিল। তাহার পরেও ইস্কুল হইতে উদ্ধারলাভ করিয়া কমলা যখন রমেশের কাছে ফিরিয়া আসিল তখনো মাঝে মাঝে এমন-সকল ঢেউ অপূর্ব সংগীতে ও অপরূপ নৃত্যে তাহার হৃদয়কে আঘাত করিয়াছে- যাহার ঠিক অর্থটি সে আজ শৈলজার এই-সমস্ত গল্পের মধ্য হইতে বুঝিতে পারিতেছে। কিন্তু তাহার এসেমস্তই ভাঙাচোরা, ইহার ধারাবাহিকতা কিছুই নাই। তাহাকে যেন কোনো-একটা পরিণাম পর্যন্ত পৌঁছিতে দেওয়া হয় নাই। শৈলজা ও বিপিনের মধ্যে যে-একটা আগ্রহের টান সেটা রমেশ ও তাহার মধ্যে কোথায়? এইযে কয়েক দিন তাহাদের দেখাশোনা বন্ধ হইয়া আছে তাহাতে তাহার মনের মধ্যে এম্‌নি কি অস্থিরতা উপস্থিত হইয়াছে–এবং রমেশও তাহাকে দেখিবার জন্য বাহিরে বসিয়া বসিয়া কোনো প্রকার কৌশল উদ্‌ভাবন করিতেছে তাহা কোনোমতেই বিশ্বাসযোগ্য নহে।
ইতিমধ্যে যেদিন রবিবার আসিল সেদিন শৈলজা কিছু মুশকিলে পড়িল। তাহার নূতন সখীকে দীর্ঘকাল একেবারে একলা পরিত্যাগ করিতে তাহার লজ্জা করিতে লাগিল, অথচ আজ ছুটির দিন একেবারে ব্যর্থ করিবে এতবড়ো ত্যাগশীলতাও তাহার নাই। এ দিকে রমেশবাবু নিকটে থাকিতেও কমলা যখন মিলনে বঞ্চিত হইয়া আছে তখন ছুটির উৎসবে নিজের বরাদ্দ পুরা ভোগ করিতে তাহার ব্যথাও বোধ হইল। আহা, যদি কোনোমতে রমেশের সহিত কমলার সাক্ষাৎ ঘটাইয়া দেওয়া যায়।
এ-সকল বিষয় লইয়া গুরুজনদের সহিত পরামর্শ চলে না। কিন্তু চক্রবর্তী পরামর্শের জন্য অপেক্ষা করিবার লোক নহেন–তিনি বাড়িতে প্রচার করিয়া দিলেন আজ তিনি বিশেষ কাজে শহরের বাহিরে যাইতেছেন। রমেশকে বুঝাইয়া গেলেন যে, বাহিরের লোক আজ কেহ তাঁহার বাড়িতে আসিতেছে না, সদর-দরজা বন্ধ করিয়া তিনি চলিয়া যাইতেছেন। এ খবর তাঁহার কন্যাকেও বিশেষ করিয়া শোনাইয়া দিলেন–নিশ্চয় জানিতেন, কোন্‌ ইঙ্গিতের কী অর্থ, তাহা বুঝিতে শৈলজার বিলম্ব হয় না।
স্নানের পর শৈলজা কমলাকে বলিল, “এসো ভাই, তোমার চুল শুকাইয়া দিই।”
কমলা কহিল, “কেন, আজ এত তাড়াতাড়ি কিসের?”
শৈলজা। সে কথা পরে হইবে, তোমার চুলটা আগে বাঁধিয়া দিই।–বলিয়া কমলার মাথা লইয়া পড়িল। আজ বিনানির সংখ্যা অনেক বেশি, খোঁপা একটা বৃহৎ ব্যাপার হইয়া উঠিল।
তাহার পরে কাপড় লইয়া উভয়ের মধ্যে একটা বিষম তর্ক বাধিয়া গেল। শৈলজা তাহাকে যে রঙিন কাপড় পরাইতে চায় কমলা তাহা পরিবার কারণ খুঁজিয়া পাইল না। অবশেষে শৈলজাকে সন্তুষ্ট করিবার জন্য পরিতে হইল।
মধ্যাহ্নে আহারের পর শৈলজা তাহার স্বামীকে কানে-কানে কী একটা বলিয়া ক্ষণকালের জন্য ছুটি লইয়া আসিল। তাহার পরে কমলাকে বাহিরের ঘরে পাঠাইবার জন্য পীড়াপীড়ি পড়িয়া গেল।
রমেশের কাছে কমলা ইতিপূর্বে অনেক বার অসংকোচে গিয়াছে। এ সম্বন্ধে সমাজে লজ্জাপ্রকাশের যে কোনো বিধান আছে তাহা জানিবার সে কোনো অবসর পায় নাই। পরিচয়ের আরম্ভেই রমেশ সংকোচ ভাঙিয়া দিয়াছিল। নির্লজ্জতার অপবাদ দিয়া ধিক্কার দিবার সঙ্গিনীও তাহার কাছে কেহ ছিল না।
কিন্তু আজ শৈলজার অনুরোধ পালন করা তাহার পক্ষে দুঃসাধ্য হইয়া উঠিল। স্বামীর কাছে শৈলজা যে-
অধিকারে যায় তাহা সে জানিয়াছে; কমলা সেই অধিকারের গৌরব যখন অনুভব করিতেছে না তখন দীনভাবে সে আজ কেমন করিয়া যাইবে!

<

Rabindranath Tagore ।। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর