রমেশের কথার মধ্যে নিঃসংশয়ের সুর শুনিয়া বৃদ্ধ হাসিয়া কহিলেন, “বার বার ভিন্ন ভিন্ন রকম স্থির করাকে স্থির করা বলে না–সে তো অস্থির করা। যা হউক, এই কাশী যাওয়াটা এখনকার মতো আপনার শেষ স্থির?”
রমেশ সংক্ষেপে কহিল, “হাঁ।”
বৃদ্ধ কোনো উত্তর না করিয়া চলিয়া গেলেন এবং জিনিসপত্র বাঁধিতে প্রবৃত্ত হইলেন। কমলা আসিয়া কহিল, “খুড়োমশায়, আজ কি আমার সঙ্গে আড়ি?”
বৃদ্ধ কহিলেন, “ঝগড়া তো দুই বেলাই হয়, কিন্তু একদিনও তো জিতিতে পারিলাম না।” কমলা। আজ যে সকাল হইতে তুমি পালাইয়া বেড়াইতেছ?
চক্রবর্তী। তোমরা যে মা, আমার চেয়ে বড়ো রকমের পলায়নের চেষ্টায় আছ, আর আমাকে পলাতক
বলিয়া অপবাদ দিতেছ?
কমলা কথাটা না বুঝিয়া চাহিয়া রহিল। বৃদ্ধ কহিলেন, “রমেশবাবু তবে কি এখনো বলেন নাই? তোমাদের যে কাশী যাওয়া স্থির হইয়াছে।”
শুনিয়া কমলা হাঁ-না কিছুই বলিল না। কিছুক্ষণ পরে কহিল, “খুড়োমশায়, তুমি পারিবে না; দাও, তোমার বাক্স আমি সাজাইয়া দিই।”
কাশী যাওয়া সম্বন্ধে কমলার এই ঔদাসীন্যে চক্রবর্তী হৃদয়ের মধ্যে একটা গভীর আঘাত পাইলেন। মনে মনে ভাবিলেন, ‘ভালোই হইতেছে, আমার মতো বয়সে আবার নূতন জাল জড়ানো কেন?’
ইতিমধ্যে কাশী যাওয়ার কথা কমলাকে জানাইবার জন্য রমেশ আসিয়া উপস্থিত হইল। কহিল, “আমি তোমাকে খুঁজিতেছিলাম।”
কমলা চক্রবর্তীর কাপড়চোপড় ভাঁজ করিয়া গুছাইতে লাগিল। রমেশ কহিল, “কমলা, এবার আমাদের গাজিপুরে যাওয়া হইল না; আমি স্থির করিয়াছি, কাশীতে গিয়া প্র্যাক্টিস করিব। তুমি কী বল?”
কমলা চক্রবর্তীর বাক্স হইতে চোখ না তুলিয়া কহিল, “না, আমি গাজিপুরেই যাইব। আমি সমস্ত জিনিসপত্র গুছাইয়া লইয়াছি।”
কমলার এই দ্বিধাহীন উত্তরে রমেশ কিছু আশ্চর্য হইয়া গেল; কহিল, “তুমি কি একলাই যাইবে না কি!”
কমলা চক্রবর্তীর মুখের দিকে তাহার সিনগ্ধ চক্ষু তুলিয়া কহিল, “কেন, সেখানে তো খুড়োমশায় আছেন।”
কমলার এই কথায় চক্রবর্তী কুণ্ঠিত হইয়া পড়িলেন; কহিলেন, “মা, তুমি যদি সন্তানের প্রতি এতদূর পক্ষপাত দেখাও, তাহা হইলে রমেশবাবু আমাকে দু চক্ষে দেখিতে পারিবেন না।”
ইহার উত্তরে কমলা কেবল কহিল, “আমি গাজিপুরে যাইব।”
এ সম্বন্ধে যে কাহারো কোনো সম্মতির অপেক্ষা আছে, কমলার কণ্ঠস্বরে এরূপ প্রকাশ পাইল না।
রমেশ কহিল, “খুড়ো, তবে গাজিপুরই স্থির।”
ঝড়জলের পর সেদিন রাত্রে জ্যোৎস্না পরিষ্কার হইয়া ফুটিয়াছে। রমেশ ডেকের কেদারায় বসিয়া ভাবিতে লাগিল, ‘এমন করিয়া আর চলিবে না। ক্রমেই বিদ্রোহী কমলাকে লইয়া জীবনের সমস্যা অত্যন্ত দুরূহ হইয়া উঠিবে। এমন করিয়া কাছে থাকিয়া দূরত্ব রক্ষা করা দুরূহ। এবারে হাল ছাড়িয়া দিব। কমলাই আমার স্ত্রী–আমি তো উহাকে স্ত্রী বলিয়াই গ্রহণ করিয়াছিলাম। মন্ত্র পড়া হয় নাই বলিয়াই কোনো সংকোচ করা অন্যায়। যমরাজ সেদিন কমলাকে বধূরূপে আমার পার্শ্বে আনিয়া দিয়া সেই নির্জন সৈকতদ্বীপে স্বয়ং গ্রনিথবন্ধন করিয়া দিয়াছেন–তাঁহার মতো এমন পুরোহিত জগতে কোথায় আছে!’
হেমনলিনী এবং রমেশের মাঝখানে একটা যুদ্ধক্ষেত্র পড়িয়া আছে। বাধা-অপমান-অবিশ্বাস কাটিয়া যদি রমেশ জয়ী হইতে পারে তবেই সে মাথা তুলিয়া হেমনলিনীর পার্শ্বে গিয়া দাঁড়াইতে পারিবে। সেই যুদ্ধের কথা মনে হইলে তাহার ভয় হয়; জিতিবার কোনো আশা থাকে না। কেমন করিয়া প্রমাণ করিবে? এবং প্রমাণ করিতে হইলে সমস্ত ব্যাপারটা লোকসাধারণের কাছে এমন কদর্য এবং কমলার পক্ষে এমন সাংঘাতিক আঘাতকর হইয়া উঠিবে যে, সে সংকল্প মনে স্থান দেওয়া কঠিন।
অতএব দুর্বলের মতো আর দ্বিধা না করিয়া কমলাকে স্ত্রী বলিয়া গ্রহণ করিলেই সকল দিকে শ্রেয় হইবে। হেমনলিনী তো রমেশকে ঘৃণা করিতেছে–এই ঘৃণাই তাহাকে উপযুক্ত সৎপাত্রে চিত্তসমর্পণ করিতে আনুকূল্য করিবে। এই ভাবিয়া রমেশ একটা দীর্ঘনিশ্বাসের দ্বারা সেইদিককার আশাটাকে ভূমিসাৎ করিয়া দিল।
নৌকাডুবি ৩০ (২)
- Details
- Rabindranath Tagore ।। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
- রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর উপন্যাস
- Category: নৌকাডুবি
- Read Time: 1 min
- Hits: 190