রমেশ বই রাখিয়া এ ঘরে উঠিয়া আসিল। জিজ্ঞাসা করিল, “কী চক্রবর্তী-খুড়ো, ব্যাপার কী? কমলা বুঝি আপনাকে–”
কমলা রমেশের মুখের দিকে না চাহিয়া তাড়াতাড়ি বলিয়া উঠিল, “না, না, আমি উঁহাকে কেবল গল্প বলিবার জন্য ডাকিয়াছিলাম।”
কিসের প্রতিবাদে যে কমলা ‘না না’ বলিল তাহা তাহাকে জিজ্ঞাসা করিলে সে বলিতে পারিত না। এই ‘না’র অর্থ এই যে, যদি মনে কর আমার ভয় ভাঙাইবার দরকার আছে–না, দরকার নাই। যদি মনে কর আমাকে সঙ্গ দিবার প্রয়োজন–না, প্রয়োজন নাই।
পরক্ষণেই কমলা কহিল, “খুড়োমশায়, রাত হইয়া যাইতেছে, আপনি শুইতে যান। একবার উমেশের খবর লইবেন, সে হয়তো ভয় পাইতেছে।”
দরজার কাছ হইতে একটা আওয়াজ আসিল “মা, আমি কাহাকেও ভয় করি না।”
উমেশ মুড়িসুড়ি দিয়া কমলার দ্বারের কাছে বসিয়া আছে। কমলার হৃদয় বিগলিত হইয়া গেল; সে তাড়াতাড়ি বাহিরে গিয়া কহিল, “হ্যাঁ রে উমেশ, তুই ঝড়-জলে ভিজিতেছিস কেন? লক্ষ্মীছাড়া কোথাকার, যা খুড়োমশায়ের সঙ্গে শুইতে যা।”
কমলার মুখে লক্ষ্মীছাড়া-সম্বোধনে উমেশ বিশেষ পরিতৃপ্ত হইয়া চক্রবর্তী-খুড়ার সঙ্গে শুইতে গেল।
রমেশ জিজ্ঞাসা করিল, “যতক্ষণ না ঘুম আসে আমি বসিয়া গল্প করিব কি?”
কমলা কহিল, “না, আমার ভারি ঘুম পাইয়াছে।”
রমেশ কমলার মনের ভাব যে না বুঝিল তাহা নয়, কিন্তু সে আর দ্বিরুক্তি করিল না; কমলার অভিমানক্ষুণ্ন মুখের দিকে তাকাইয়া সে ধীরে ধীরে আপন কক্ষে চলিয়া গেল।
বিছানার মধ্যে স্থির হইয়া ঘুমের অপেক্ষায় পড়িয়া থাকিতে পারে, এমন শান্তি কমলার মনে ছিল না। তবু সে জোর করিয়া শুইল। ঝড়ের বেগের সঙ্গে জলের কল্লোল ক্রমে বাড়িয়া উঠিল। খালাসিদের গোলমাল শোনা যাইতে লাগিল। মাঝে মাঝে এঞ্জিন-ঘরে সারেঙের আদেশসূচক ঘণ্টা বাজিয়া উঠিল। প্রবল বায়ুবেগের বিরুদ্ধে জাহাজকে স্থির রাখিবার জন্য নোঙর-বাঁধা অবস্থাতেও এঞ্জিন ধীরে ধীরে চলিতে থাকিল।
কমলা বিছানা ছাড়িয়া কামরার বাহিরে আসিয়া দাঁড়াইল। ক্ষণকালের জন্য বৃষ্টির বিশ্রাম হইয়াছে, কিন্তু ঝড়ের বাতাস শরবিদ্ধ জন্তুর মতো চীৎকার করিয়া দিগ্বিদিকে ছুটিয়া বেড়াইতেছে। মেঘসত্ত্বেও শুক্লচতুর্দশীর আকাশ ক্ষীণ আলোকে অশান্ত সংহারমূর্তি অপরিস্ফুটভাবে প্রকাশ করিতেছে। তীর স্পষ্ট লক্ষ্য হইতেছে না; নদী ঝাপসা দেখা যাইতেছে; কিন্তু ঊর্ধ্বে নিমেন, দূরে নিকটে, দৃশ্যে অদৃশ্যে একটা মূঢ় উন্মত্ততা, একটা অন্ধ আন্দোলন যেন অদ্ভুত মূর্তি পরিগ্রহ করিয়া যমরাজের উদ্যতশৃঙ্গ কালো মহিষটার মতো মাথা ঝাঁকা দিয়া দিয়া উঠিতেছে।
এই পাগল রাত্রি, এই আকুল আকাশের দিকে চাহিয়া, কমলার বুকের ভিতরটা যে দুলিতে লাগিল তাহা ভয়ে কি আনন্দে নিশ্চয় করিয়া বলা যায় না। এই প্রলয়ের মধ্যে যে একটা বাধাহীন শক্তি, একটা বন্ধনহীন স্বাধীনতা আছে, তাহা যেন কমলার হৃদয়ের মধ্যে একটা সুপ্ত সঙ্গিনীকে জাগাইয়া তুলিল। এই বিশ্বব্যাপী, বিদ্রোহের বেগ কমলার চিত্তকে বিচলিত করিল। কিসের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ, তাহার উত্তর কি এই ঝড়ের গর্জনের মধ্যে পাওয়া যায়? না, তাহা কমলার হৃদয়াবেগেরই মতো অব্যক্ত। একটা কোন্ অনির্দিষ্ট অমূর্ত মিথ্যার, স্বপ্নের, অন্ধকারের জাল ছিন্নবিচ্ছিন্ন করিয়া বাহির হইয়া আসিবার জন্য আকাশপাতালে এই মাতামাতি, এই রোষগর্জিত ক্রন্দন। পথহীন প্রান্তরের প্রান্ত হইতে বাতাস কেবল ‘না না’ বলিয়া চীৎকার করিতে করিতে নিশীথরাত্রে ছুটিয়া আসিতেছে–একটা কেবল প্রচণ্ড অস্বীকার। কিসের অস্বীকার? তাহা নিশ্চয় বলা যায় না-কিন্তু না–কিছুতেই না, না, না, না।
নৌকাডুবি ২৯ (৩)
- Details
- Rabindranath Tagore ।। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
- রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর উপন্যাস
- Category: নৌকাডুবি
- Read Time: 1 min
- Hits: 233