কমলার এখনো অল্প বয়স–কোনো সংশয় আশঙ্কা বা বেদনা স্থায়ী হইয়া তাহার মনের মধ্যে টিঁকিয়া থাকিতে পারে না।
রমেশের ব্যবহার সম্বন্ধে এ কয়দিন সে আর-কোনো চিন্তা করিবার অবকাশ পায় নাই। স্রোত যেখানে বাধা পায় সেইখানে যত আবর্জনা আসিয়া জমে–কমলার চিত্তস্রোতের সহজ প্রবাহ রমেশের আচরণে হঠাৎ একটা জায়গায় বাধা পাইয়াছিল, সেইখানে আবর্ত রচিত হইয়া নানা কথা বারবার একই জায়গায় ঘুরিয়া বেড়াইতেছিল। বৃদ্ধ চক্রবর্তীকে লইয়া হাসিয়া, বকিয়া, রাঁধিয়া, খাওয়াইয়া কমলার হৃদয়স্রোত আবার সমস্ত বাধা অতিক্রম করিয়া চলিয়া গেল; আবর্ত কাটিয়া গেল; যাহা-কিছু জমিতেছিল এবং ঘুরিতেছিল তাহা সমস্ত ভাসিয়া গেল। সে আপনার কথা আর কিছুই ভাবিল না।
আশ্বিনের সুন্দর দিনগুলি নদীপথের বিচিত্র দৃশ্যগুলিকে রমণীয় করিয়া তাহারই মাঝখানে কমলার এই প্রতিদিনের আনন্দিত গৃহিণীপনাকে যেন সোনার জলের ছবির মাঝখানে এক-একটি সরল কবিতার পৃষ্ঠার মতো উল্টাইয়া যাইতে লাগিল।
কর্মের উৎসাহে দিন আরম্ভ হইত। উমেশ আজকাল আর স্টীমার ফেল করে না, কিন্তু তাহার ঝুড়ি ভর্তি হইয়া আসে। ক্ষুদ্র ঘরকন্নার মধ্যে উমেশের এই সকালবেলাকার ঝুড়িটা পরম কৌতূহলের বিষয়। ‘এ কী রে, এ যে লাউডগা! ওমা, শজনের খাড়া তুই কোথা হইতে জোগাড় করিয়া আনিলি? এই দেখো দেখো, খুড়োমশায়, টক-পালং যে এই খোট্টা র দেশে পাওয়া যায় তাহা তো আমি জানিতাম না।’ ঝুড়ি লইয়া রোজ সকালে এইরূপ একটা কলরব উঠে। যেদিন রমেশ উপস্থিত থাকে সেদিন ইহার মধ্যে একটু বেসুর লাগে–সে চৌর্য সন্দেহ না করিয়া থাকিতে পারে না। কমলা উত্তেজিত হইয়া বলে, “বাঃ, আমি নিজের হাতে উহাকে পয়সা গনিয়া দিয়াছি।”
রমেশ বলে, “তাহাতে উহার চুরির সুবিধা ঠিক দ্বিগুণ বাড়িয়া যায়। পয়সাটাও চুরি করে, শাকও চুরি করে।”
এই বলিয়া রমেশ উমেশকে ডাকিয়া বলে, “আচ্ছা, হিসাব দে দেখি।”
তাহাতে তাহার এক বারের হিসাবের সঙ্গে আর-এক বারের হিসাব মেলে না। ঠিক দিতে গেলে জমার চেয়ে খরচের অঙ্ক বেশি হইয়া উঠে। ইহাতে উমেশ লেশমাত্র কুণ্ঠিত হয় না। সে বলে, “আমি যদি হিসাব ঠিক রাখিতে পারিব তবে আমার এমন দশা হইবে কেন? আমি তো গোমস্তা হইতে পারিতাম, কী বলেন দাদাঠাকুর?”
চক্রবর্তী বলেন, “রমেশবাবু, আহারের পর আপনি উহার বিচার করিবেন, তাহা হইলে সুবিচার করিতে পারিবেন। আপাতত আমি এই ছোঁড়াটাকে উৎসাহ না দিয়া থাকিতে পারিতেছি না। উমেশ, বাবা, সংগ্রহ করার বিদ্যা কম বিদ্যা নয়; অল্প লোকেই পারে। চেষ্টা সকলেই করে; কৃতকার্য কয়জনে হয়? রমেশবাবু, গুণীর মর্যাদা আমি বুঝি। শজনে-খাড়ার সময় এ নয়, তবু এত ভোরে বিদেশে শজনের খাড়া কয়জন ছেলে জোগাড় করিয়া আনিতে পারে বলুন দেখি। মশায়, সন্দেহ করিতে অনেকেই পারে; কিন্তু সংগ্রহ করিতে হাজারে একজন পারে।”
রমেশ। খুড়ো, এটা ভালো হইতেছে না, উৎসাহ দিয়া অন্যায় করিতেছেন।
চক্রবর্তী। ছেলেটার বিদ্যে বেশি নেই, যেটাও আছে সেটাও যদি উৎসাহের অভাবে নষ্ট হইয়া যায় তো বড়ো আক্ষেপের বিষয় হইবে–অন্তত যে কয়দিন আমরা স্টীমারে আছি। ওরে উমেশ, কাল কিছু নিমপাতা জোগাড় করিয়া আনিস; যদি উচ্ছে পাস আরো ভালো হয়–মা, সুক্তুনিটা নিতান্তই চাই। আমাদের আয়ুর্বেদে বলে-থোক্, আয়ুর্বেদের কথা থাক্, এ দিকে বিলম্ব হইয়া যাইতেছে। উমেশ, শাকগুলো বেশ করে ধুয়ে নিয়ে আয়।
রমেশ এইরূপে উমেশকে লইয়া যতই সন্দেহ করে, খিট্খিট্ করে, উমেশ ততই যেন কমলার বেশি করিয়া আপনার হইয়া উঠে। ইতিমধ্যে চক্রবর্তী তাহার পক্ষ লওয়াতে রমেশের সহিত কমলার দলটি যেন বেশ একটু স্বতন্ত্র হইয়া আসিল। রমেশ তাহার সূক্ষ্ম বিচারশক্তি লইয়া এক দিকে একা; অন্য দিকে কমলা উমেশ এবং চক্রবর্তী তাহাদের কর্মসূত্রে, স্নেহসূত্রে, আমোদ-আহ্লাদের সূত্রে ঘনিষ্ঠভাবে এক। চক্রবর্তী আসিয়া অবধি তাঁহার উৎসাহের সংক্রামক উত্তাপে রমেশ কমলাকে পূর্বাপেক্ষা বিশেষ ঔৎসুক্যের সহিত দেখিতেছে, কিন্তু তবু দলে মিশিতে পারিতেছে না। বড়ো জাহাজ যেমন ডাঙায় ভিড়িতে চায়, কিন্তু জল কম বলিয়া তাহাকে তফাতে নোঙর ফেলিয়া দূর হইতে তাকাইয়া থাকিতে হয়, এ দিকে ছোটো ছোটো ডিঙি-পানসিগুলো অনায়াসেই তীরে গিয়া ভিড়ে, রমেশের সেই দশা হইয়াছে।
নৌকাডুবি ২৯
- Details
- Rabindranath Tagore ।। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
- রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর উপন্যাস
- Category: নৌকাডুবি
- Read Time: 1 min
- Hits: 178