আমাদের দেশের সঙ্গে তুলনা করলে কানাডাকে মনে হয় মরুভূমি। না, মরুভূমির তুলনাটা ঠিক হল না। বরং বলা উচিত একটি উর্বর, অতি জনবিরল দেশ। কয়েকটা বড় শহর বাদ দিলে শত শত মাইল যেন জায়গা খালি পড়ে আছে। আমেরিকায় যেমন গ্রাম নেই, আছে অসংখ্য ছোট শহর, সেইরকম ছোট শহর কানাডাতেও আছে, আরও ছোট, ধূ-ধূ করা মাঠের মধ্যে দু-তিনটে মাত্র বাড়ি, এমনও চোখে পড়ে।

কানাডার রাস্তাগুলোও আমেরিকার চেয়ে বেশি চওড়া মনে হয়, কারণ রাস্তায় গাড়ি কম। তা বলে যে এদেশের লোক গাড়ি কিনতে পারে না তা নয়, প্রত্যেক পরিবারেই অন্তত দুটো করে গাড়ি, কিন্তু লোক সংখ্যাই তো কম। তবু সারা দেশটায় আষ্টেপৃষ্টে চওড়া-চওড়া মসৃণ রাস্তা ছড়িয়ে আছে।

ইতিহাসেই দেখা যায় মানুষের মধ্যে যাযাবর বৃত্তি রয়ে গেছে এখনও। নিজ বাসভূমি শস্য ফলমূলের অনটন দেখলেই মানুষ বারবার অন্য বাসভূমির সন্ধানে ছুটে যায়। স্বদেশপ্রেম একটা আইডিয়া মাত্র, যা নিয়ে কবিরা অনেক আবেগের মাতামাতি করেছে এবং যুদ্ধবাজ ও রাজনীতিবিদরা তাতে ইন্ধন জুগিয়ে এসেছে নিজেদের স্বার্থে। আসলে, যেখানে ভালো খাবারদাবার, স্বাচ্ছন্দ্য ও নিরাপত্তা আছে, সেখানে ছুটে যাওয়াই মানুষের স্বাভাবিক প্রবৃত্তি। গ্রাম ছেড়ে যেকারণে মানুষ শহরে চলে আসে, সেই কারণেই কলকাতা-বোম্বাই-লন্ডনের মতন পিঁপড়ে শহর ছেড়ে মানুষ কানাডা-অস্ট্রেলিয়ায় গেছে নতুন সম্ভাবনার প্রত্যাশায়।

সাহেবরা আগে গিয়ে দখল করে নিয়েছে বলে কানাডা সাহেবদের দেশ। কিন্তু পিছু পিছু অ সাহেবরাও গেছে। ভারতীয়রা গেছে এ শতাব্দীর গোড়া থেকেই, জাপানিরা গেছে, আফ্রিকা ও পশ্চিম ভারতীয় দ্বীপপুঞ্জ থেকে গেছে, আর চিনেরা গিয়ে বসতি স্থাপন করেনি, পৃথিবীতে এমন কোনও জায়গাই নেই। কিন্তু তেলে-জলে যেমন মিশ খায় না, সেই রকম সাদা-কালো-হলদে খয়েরি জাতিগুলির মধ্যে মেশামিশির কোনও ব্যাপারই ঘটেনি, ক্রমশ দূরত্ব যেন আরও বেড়েই চলেছে।

সাদায়-কালোয় ভেদাভেদের কথা যেমন প্রায়ই শোনা যায়, তেমনি দূরত্ব ঘোচাবার কথাও মাঝে-মাঝেই ওঠে। কিন্তু কালো-হলদে-খয়েরি জাতিগুলির মধ্যে সম্পর্ক স্থাপনের কোনও উদ্যমই নেই। খয়েরিরা কালোদের চেয়ে সাদাদের বেশি পছন্দ করে, তাদের সঙ্গে কাঁধ ঘষাঘষি করতে চায়, আবার সাদারা এখন খয়েরিদের চেয়ে বেশি পছন্দ করে হলদেদের। এইরকম রঙের খেলা চলছে আর কি। ভারতী মুখার্জি নামে একজন লেখিকা, যাঁর স্বামী কেনেডিয়ান, অনেক দিন ছিলেন ওদেশে, বর্ণ-বিদ্বেষের ব্যাপারে তিতিবিরক্তি হয়ে তিনি গত বছর কাগজে বিবৃতি দিয়েছেন যে, জীবনে আর তিনি দেশে ফিরবেন না।

বর্ণবিদ্বেষ নিয়ে অবশ্য কিছু বলা আমার মানায় না। কারণ আমি আসছি এমন একটা দেশ থেকে, যার মতন বর্ণবিদ্বেষী দেশ সারা পৃথিবীতে আর একটিও নেই। আমাদের দেশে এখনও কাগজে বিয়ের বিজ্ঞাপনে পাত্রীর রং ফরসা না কালো সেটাই প্রধান ব্যাপার। আমাদের দেশে হরিজনদের এখনও পুড়িয়ে মারা হয়, আরও যা সব আছে তা বলার দরকার নেই।

এই প্রসঙ্গে একটা মজার ঘটনা মনে পড়ল।

অনেক সময় হয় না যে পৃথিবীর অন্য প্রান্তে গিয়ে একজনের সঙ্গে নতুন আলাপ হল, তারপর কথায়-কথায় জানা গেল, উনি আমার ভাইবোন, অনেক আত্মীয় বন্ধুকে চেনেন, আর আমিও ওঁর আত্মীয়-বন্ধুদের অনেককে খুব ভালো চিনি, শুধু আমাদের দুজনেরই আগে দেখা হয়নি! সেইরকমই এ দেশে এসে আলাপ হল মীর চন্দানি নামে একজনের সঙ্গে, তাঁর স্ত্রী উগান্ডার ক্রিশ্চান, এককালের ক্ষীণ যোগাযোগ ছিল আমাদের দেশের গোয়ার সঙ্গে। মীর চন্দানির সঙ্গে কিছুক্ষণ কথা বলার পরই আমরা আবিষ্কার করলুম যে, এককালে উনি কলকাতায় আমাদের ঠিক পাশের বাড়িতেই থাকতেন, ওঁর দাদার ছেলে আমার খুব বন্ধু, উনিও আমার বাবাকে খুব ভালো চিনতেন। তখন উনি ছিলেন অবিবাহিত, সে প্রায় পনেরো বছর আগেকার কথা। মীর চন্দানি খুব আবেগের সঙ্গে কলকাতার স্মৃতি রোমন্থন করতে লাগলেন। কথায়-কথায় জিগ্যেস করলেন, অশোককে মনে আছে? সে কেমন আছে?

আমি জিগ্যেস করলুম, কোন অশোক?

উনি বললেন, সেই যে অশোক..পড়াশুনোয় খুব ভালো ছিল, ওর পদবি ছিল বোধহয় মিত্র, তাইনা?

এখন ব্যাপার হয়েছে কী, সেই সময় আমরা কলকাতায় যে পাড়ায় থাকতুম, সেই পাড়ায় একই রাস্তায়, খুব কাছাকাছি বাড়িতে দুজন অশোক মিত্র থাকতেন, দুজনেই পড়াশুনোয় ভালো। এতে আশ্চর্যের কিছু নেই, সাংবাদিকতার জগতে যদি দুজন অমিতাভ চৌধুরী থাকতে পারেন, তাহলে এক পাড়ায় দুজন অশোক মিত্র থাকা কিছু অস্বাভাবিক নয়। একজন ফরসা ছিপছিপে, লম্বা, অন্যজন কালো, মাঝারি উচ্চতা। দুজনকে আলাদা করে বোঝাবার জন্য আমরা বলতুম, কালো অশোক, ফরসা অশোক।

সেই জন্যই জিগ্যেস করেছিলুম, কোন অশোক বলুন তো?কালো রঙের?

মীর চন্দানি বললেন, না, না, সে বেশ ফরসা ছিল, কোয়াইট হ্যান্ডসাম…

আমি বললুম, বুঝেছি, তবে সেই অশোক মিত্রের সঙ্গে আমার ভালো পরিচয় ছিল না, কালো অশোককেই বেশি চিনতুম।

মীর চন্দানি বললেন, নাও আই রিমেমবার কালো অশোকও একজন ছিল বটে…

কথাবার্তা হচ্ছিল ইংরেজিতে, হঠাৎ পাশ থেকে শ্রীমতী মীর চন্দানি দারুণ ঝাঁঝের সঙ্গে বলে উঠলেন তোমাদের লজ্জা করে না, তোমরা ভারতীয়দের সম্পর্কে কথা বলতে গিয়েও একজনকে কালো বলছ?

আমি প্রথমটায় হতভম্ব হয়ে গিয়েছিলুম। ভদ্রমহিলা এমন রেগে উঠলেন কেন?

কোনওরকমে বোঝাবার চেষ্টা করলুম যে, না, না, না, এর মধ্যে বর্ণবিদ্বেষের কোনও ব্যাপার নেই, একই নামের দুজন লোকের একজন কালো, অন্যজন ফরসা, সেটা বোঝাবার জন্যই

ভদ্রমহিলা আবার ধমক দিয়ে বললেন, ফের বলছ কালো-ফরসা? অল ইন্ডিয়ানস আর ব্ল্যাকস। সেটা তোমরা মানতে চাও না। কালো-জাতি বলে তোমাদের গর্ববোধ নেই, দ্যাখো তো চিনে বা জাপানিদের…।

সাহেবদের চোখে সব ভারতীয়ই যে কালো, এটা সত্যিই আমাদের মনে থাকে না। আমরা আফ্রিকান বা ওয়েস্ট ইন্ডিয়ান কালোদের অপছন্দ করি, নিজেরা খয়েরি সেজে সাদাদের কাছাকাছি যেতে চাই। অবশ্য আমার গায়ের রং এমনই ছাতার কাপড়ের মতন যে আমার পক্ষে কোনওদিন খয়েরি সাজবারও উপায় নেই।

কানাডার জনসংখ্যা যে বিরল সেটা সব সময়েই মনে পড়ে। একটি বাঙালি মেয়ে কানাডায় এসে বলেছিল, ইচ্ছে করে গড়িয়াহাট থেকে এক গুচ্ছের লোক এনে এখানে ছড়িয়ে দিই!

গড়িয়াহাটের চেয়েও শ্যামবাজার কিংবা শিয়ালদায় ভিড় অনেক বেশি। হাঁটতে গেলে মানুষের গায়ে ধাক্কা লাগেই। পৃথিবীতে সবচেয়ে বড় শহর বোধ হয় এখন মেক্সিকো সিটি। একটি মেক্সিকান মহিলাকে জিগ্যেস করেছিলুম, তোমাদের শহরে হাঁটতে গেলে কি মানুষের সঙ্গে মানুষের ধাক্কা লাগে? সে আমতা-আমতা করে বলেছিল না, মানে, বাজারে কিংবা মেলায় হাঁটতে গেলে সেরকম হতে পারে,…না কিন্তু রাস্তায়…তো! টোকিও, নিউইয়র্কের মতন বাঘা-বাঘা শহরের তুলনায় আয়তনে বা জনসংখ্যায় কলকাতার স্থান বেশ নীচে। তবু কলকাতার মতন এমন ভিড় বোধ হয় আর কোথাও নেই।

কানাডা এত ফাঁকা বলে যে আমাদের দেশের বেকাররা সে দেশে দলে-দলে ছুটে যেতে পারবে, সেরকম সুদিন আর নেই। এখন কড়াকড়ি এবং ভিসা ব্যবস্থা হয়েছে। সাদা মানুষ হলে এখনও কানাডায় বসতি নেওয়ার সুযোগ আছে অবশ্য, কিন্তু ভারতীয়দের প্রবেশ অধিকার কমে আসছে ক্রমশই। মাঝে-মাঝে শ্বেতাঙ্গদের সঙ্গে ভারতীয়দের মারামারিও হয়। সেরকম খবর তো আমরা দেশের কাগজেও পড়ি। এখানে এসে টরেন্টোর একটা ঘটনা শুনলুম। একটি বাঙালির নতুন তৈরি সুদৃশ্য বাড়ির জানলার কাঁচ পাড়ার কোনও লোক ঢিল মেরে ভেঙে দেয়। একবার নয়, দুবার। বাঙালি ভদ্রলোকটি পুলিশে খবর দিলেও সুরাহা হয় না। পুলিশ বলে, কে ভেঙেছে সেটা না বলতে পারলে পুলিশ কাকে ধরবে? পরের বার ভদ্রলোক তক্কে ছিলেন। একটি ছোঁকরা যেই কাঁচে ঢিল ছুঁড়েছে, অমনি তিনি ছুটে গিয়ে ছেলেটিকে জাপটে ধরলেন, এবং টানতে-টানতে তাকে নিয়ে গেলেন থানায়। এবারেও পুলিশের কোনও গা নেই। ছেলেটিকে ছেড়ে দিয়ে পুলিশ ওই ভদ্রলোককে বললেন, এ ছেলেটিই যে ঢিল ছুঁড়েছেন তার প্রমাণ কী? আর কেউ দেখেছে? কোনও সাক্ষী ছিল?

অর্থাৎ শুধু চোর ধরলেই হবে না, চুরি বা গুন্ডামির সময় একজন সাক্ষীও রাখতে হবে, আর তাকেও ধরে নিয়ে যেতে হবে থানায়। সাহেব পুলিশের কী অপূর্ব কৃতিত্ব।

সেই বাঙালি ভদ্রলোককে তাঁর এক পাঞ্জাবি বন্ধু পরামর্শ দিয়েছিলেন, ওসব পুলিশ-টুলিশে অভিযোগ করে কোনও কাজ হবে না, বাড়িতে ডান্ডা রাখবেন, কেউ কাঁচ ভাঙতে এলে সোজা কয়েক ঘা কষিয়ে দেবেন!

বাঙালিরা অবশ্য ডান্ডা চালাতে তেমন দক্ষ নয়, অনেক জায়গাতেই তাদের চুপ করে সহ্য করে যেতে হয়। কিন্তু পাঞ্জাবিরা ছেড়ে কথা কয় না, বেশ কয়েকবার তারা হামলাবাজদের বেধড়ক মার দিয়েছে।

দীপকদার বাড়ি এডমান্টন শহর থেকে একটু দূরে সেই সেন্ট অ্যালবার্ট নামে একটা ছোট্ট ছিমছাম সুন্দর জায়গায়। কানাডায় টরেন্টো, মন্ট্রিয়েল, কুইবেকের মতন শহরগুলোর তুলনায় এডমান্টন আমাদের কাছে তেমন পরিচিত নয়। কিন্তু এখন ওদের এডমান্টনই সবচেয়ে দ্রুত বর্ধমান শহর, কারণ যে-প্রদেশের এটি প্রধান শহর, সেই আলবার্টায় সম্প্রতি প্রচুর পেট্রল বেরিয়েছে। পেট্রল মানেই বহু টাকার ছড়াছড়ি, অনেক রকম নতুন ব্যাবসা এবং মধু-সন্ধানী বহু মানুষের ভিড়। এডমন্টনে এমন ঝকঝকে ও বিশাল শপিং মল দেখেছি যে, মনে হয় ওরকম দোকান-সমারোহ ইওরোপেও নেই।

এডমান্টন থেকে সেন্ট অ্যালবার্টে যেতে মাঝখানে একটি নদী পড়ে। সে নদীর নাম সাসকাচুয়ান। যাওয়া-আসার পথে সেই নদীটার দিকে বারবার উৎসুকভাবেই তাকাই। নতুন নামের নদী দেখতে পেলেই আমার মনটা চঞ্চল হয়ে ওঠে।

সাসকাচুয়ান নদীর পাশে উদ্যান আছে, জলে বোটিং হয়, ছিপ নিয়ে কেউ মাছ ধরার জন্য বসেও থাকে, কিন্তু কোনওদিন কারুকে স্নান করতে দেখিনি। নদীর জলে কিছু লোক দাপাদাপি।

করলে সে নদীকে যেন ন্যাড়া-ন্যাড়া দেখায়। ঠান্ডার জন্য নয় কিন্তু, জুলাই-আগস্টে কানাডায় বেশ গরম পড়ে। জামার তলায় গেঞ্জি ভিজে যায়। ভয়টা বোধ হয় পলিউশনের। উত্তর আমেরিকার অধিবাসীরা স্নান করতে বা সাঁতার কাটতে খুব ভালোবাসে, সেই রকমই ওদের আবার পরিষ্কার বাতিক। অনেক বাড়িতেই নিজস্ব পুকুর আছে, যার পোশাকি নাম সুইমিং পুল। সেগুলো আসলে বড়সড়ো চৌবাচ্চা, আগাগোড়া সিমেন্ট বাঁধানো, জলের রং কৃত্রিম নীল, সামান্য ধুলোবালি বা একটা গাছের পাতা পর্যন্ত পড়বার উপায় নেই। প্রত্যেক শহরে পাবলিক সুইমিং পুলও আছে অনেক, যেখানে পয়সা দিয়ে সাঁতার কাটা যায়। কিন্তু বাড়ির কাছে নদী থাকলেও কেউ নামবে না। বিংশ শতাব্দীর সভ্যতাকে বলা চলে নদী-ঘাতক। পৃথিবীর প্রায় সব দেশেই নদীগুলোকে নানানভাবে বেঁধে দুর্বল করে ফেলেছে। তা ছাড়া দু-পাড়ের নদীগুলোকে অনবরত সব নদীতে নোংরা ঢালছে।

জয়তীদির এক বান্ধবীর ভাই একদিন কাছাকাছি একটা ছোট হ্রদে গিয়েছিল মাছ ধরতে। তারপর সে সত্যি কয়েকটা মাছ পেয়েছিল, ফেরার পথে জয়তীদিকে একটা মাছ উপহার দিয়ে গেল। মাছটার চেহারা একটু অদ্ভুত, অনেকটা যেন শোল মাছ আর কাতলা মাছ মেশানো। একটা নতুন জাতের মাছ খাওয়া হবে ভেবে আমি বেশ উৎসাহিত হয়েছিলুম, রাত্তিরবেলা জয়তীদি অম্লানবদনে বললেন, সে মাছটা তো আমি ফেলে দিয়েছি!

দীপকদা মাছের ভক্ত নন, তাঁর কোনও তাপ-উত্তাপ দেখা গেল না। কিন্তু আমি চমকে উঠে বললুম, সে কী! আস্ত মাছটা?

জয়তীদি বললেন, কী জানি কী অচেনা মাছ, তা ছাড়া যে লেক থেকে ধরেছে, সেটা পলিউটেড কিনা কে জানে! এখানকার জল যা নোংরা…।

নতুন ধরনের মাছ অবশ্য খাওয়া হল কয়েকদিন পরেই। দীপকদাদের এক বন্ধু দিলীপবাবু একদিন আমাদের খাওয়ার নেমন্তন্ন করলেন। খাওয়ার টেবিলে যখন মাছ এল, তখন তিনি বললেন, এ মাছ কোথাকার জানেন তো, উত্তর মেরুর।

দীপকদা একটু বাড়িয়ে বলেছিলেন, ওদের বাড়ি থেকে উঁকি দিয়ে উত্তর মেরু দেখা যায় না। তবে অ্যালবার্টার ওপর দিকেই কানাডার সীমান্ত প্রদেশ, তারপর হিম রাজ্য। ম্যাপে দেখলে এখান থেকে উত্তর মেরু খুব দূর মনে হয় না। দীপকদার বন্ধু দিলীপবাবু সরকারি কর্মচারী, কাজের জন্য তাঁকে সীমান্ত প্রদেশে যেতে হয়, সেখান থেকে তিনি নিয়ে এসেছেন উত্তর মেরুর রুই মাছ।

উত্তর মেরুর মাছ খাচ্ছি, ভাবলেই রোমাঞ্চ হয় না? অবশ্য এক্সিমোরাও কোনওদিন গঙ্গার ইলিশ খেলে একই রকম রোমাঞ্চিত বোধ করবে বোধ হয়।

কয়েকদিন কানাডায় থেকেই আমি বেশ পুরোনো হয়ে গেলুম। মাঝে-মাঝে দীপকদাদের বাড়িতে আমি একদম একাই থাকি। দীপকদা পণ্ডিত মানুষ, তিনি এখানকার একটা বিশ্ববিদ্যালয়ে পদার্থ বিদ্যার অধ্যাপক। জয়তীদি কলকাতা থেকে অর্থনীতিতে এম এ পাশ করে এসে অনেকদিন কানাডায় ঘরসংসার করেছেন। ইদানীং তাঁর শখ হয়েছে আবার পড়াশুনো করার, তিনি ভরতি হয়েছেন আর একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে। ওদের দুটি মেয়ে জিয়া আর প্রিয়া কাছাকাছি একটা স্কুলে পড়ে। সকাল বেলা ছোট-হাজরি খেয়ে ওরা চারজনেই চলে যায়। তারপর বাড়িতে আমি একলা।

একদিন মনে হল, শুধু-শুধু জয়তীদিদের বাড়িতে রয়েছি আর দু-বেলা অন্ন ধ্বংস করছি, বিনিময়ে আমারও কিছু করা উচিত। এদেশে সবাই কাজের মানুষ, চুপচাপ কেউ বসে থাকে না।

জয়তীদির বাড়ির ঘর ঝাঁট দিয়ে, বাসনপত্তর মেজেও তো খানিকটা সাহায্য করা যায়।

এ দেশে কেউ কাজ করলেই তার জন্য পারিশ্রমিক পায়। শারীরিক কাজে বেশি দক্ষিণা। ছেলেও যদি বাড়ির বাগান পরিষ্কার করে, তা বলে বাবার কাছ থেকে মজুরির টাকা চায়। ঘর মোছা, বাসন মাজার জন্য আমিও জয়তীদির কাছ থেকে বেশ মোটা মাইনে দাবি করতে পারি! তা হলে আমার চিন্তা কী, পরবর্তী বেড়াবার খরচটাও এইভাবে তুলে ফেলা যাবে!

<

Sunil Gangapadhyay।। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়