অনেকদিন নিতাইয়ের সঙ্গে দেখা-সাক্ষাৎ নেই, ছাতাটা হাতে নিয়ে রোদের মধ্যে বেরিয়ে পড়ে নবকুমার। আজ ছুটির দিনে বাসায় আছে নিশ্চয়। নিতাই চলে যাবার পর প্রথম প্রথম নিতাইয়ের সামনে মুখ তুলে দাঁড়াতে লজ্জা করত, নিজেকে ভারী অপরাধী মনে হত, কিন্তু সময়ে সবই সয়। সেই লজ্জা একটু একটু করে কমেছে। সত্যবতীই বার বার ঠেলে পাঠিয়েছে নেমন্তন্ন করতে। আর অবাক কাণ্ড, দিব্যি সহজভাবে নিতাইয়ের সঙ্গে কথা কয়েছে সত্য, নিতাই যা যা ভালবাসে, মনে করে করে বেঁধেছে, অনুরোধ উপরোধ করে খাইয়েছে।

       এই সব অসমসাহসিক কাণ্ডগুলো কী করেই যে করে সত্য! যাক, আজ নবকুমার নিজেই যাচ্ছে। আজ বাড়িতে মন বসল না। সেই যে পরশু সন্ধ্যেবেলা পঞ্চুর মা কোথা থেকে একটা বিধবা মেয়েছেলে নিয়ে এসে বকবক করল, তারপর থেকেই সত্য যেন কেমন হয়ে গেছে। কথা নেই বার্তা নেই, ছেলেদের সঙ্গে হাসিখুশি নেই, যেন কোন্ জগতে বাস করছে।

কথাটা সত্যি–পরশু থেকে সত্য এক ধাঁধার জগতে বাস করছে।

কাকে নিয়ে এল পঞ্চুর মা? শুধু দত্তবাড়ির পানসাজুনি? তাহলে কি জন্যেই বা এল সে?

সত্যকে দর্শন করার বাসনা এমন প্রবল হবার হেতু কি তার? তা তাই যদি হয়, মন খুলে কথাই বা কইল কই? কেমন চেপে চেপে রেখে রেখে কথা, থেমে থেমে নিঃশ্বাস, ভেতরে যেন কত কি!

ওকে কি সত্য আগে কোথাও দেখেছে? সত্যর খুব একটা চেনা মানুষের মতন কি দেখতে ও? কিন্তু সে মানুষটা তো এমন পোড়ামূর্তি ছিল না! ওর নিয়তি কি শেষ অবধি আগুন হয়ে ওকে ঝলসা পোড়া করে ছেড়েছে?

দুজনের মধ্যেই যেন উত্তাল ঢেউ, কিন্তু কেউই নিজে থেকে এগিয়ে এসে খপ করে হাত ধরে বলে উঠল না, তুমি সেই না?

পঞ্চুর মা খনখন করে বলে উঠেছিল, কই গো বামুনদি, এত আগ্রহ করে এলে, অথচ বাক্যি ওকি নেই কেন?

সেই বামুনদি আস্তে আস্তে বলেছিল, কথা কইতে তো আসি নি, দেখতে এসেছি।

গলার শব্দটা কি সত্যর শোনা নয়?

যেন অনেক সাগরের ওপারে অনেক যুগের আগে সত্য এই স্বর শুনেছে। তবু বলতে পারা যায় নি, আমার চোখকে তুমি ফাঁকি দিতে পারবে না গো, আমি বড় ধুরন্ধর মেয়ে।

বাধা অনেক।

হয় কি নয়, নয় কি হয়–এর আলো-আধারির বাধা, সমাজ-সামাজিকের বাধা, অবস্থার তারতম্যের বাধা, সর্বোপরি পঞ্চুর মার উপস্থিতির বাধা, সেটাই হয়েছিল বোধ করি সব থেকে বড় বাধা। হঠাৎ একলা দুজনে মুখোমুখি দাঁড়ালে হয়তো অন্য বাধাগুলো মুহর্তে খসে পড়ত, হয়তো দ্বিধামাত্র না করে ঝপ করে বলে ফেলা হত, শেষ অবধি তা হলে এই হাল হয়েছে? বেশ ভাল। সুখটা করলে ভাল! আগে হলেও বলতো। অনেক যুগ আগে ছেলেমানুষ ছিল সত্য, এখন তো নেই।

তাই সে সব হল না। খানিক পরে পঞ্চুর মা হাই তুলে বলল, চল তা হলে বামুনদি, তোমাকে দুয়োর অবধি এগিয়ে দিয়ে আমি ঘরে যাই। সারাটা দিন রপটানি গেছে, চোখ ভেঙে ঘুম আসছে।

চল। বলে উঠে পড়েছিল সে। বলে নি, আর একটু থাকি না!

সত্য বলে নি, আর একটু বসো না!

সেই অবধি বিমনা হয়ে রয়েছে সত্য।

নবকুমার বলেছিল, পঞ্চুর মার সঙ্গে ওই মাগীটা কে এসেছিল? কেন।

কথা শেষ করতে পারে নি, তীব্র স্বরে থামিয়ে দিয়েছিল তাকে, ছেলেপেলের সামনে অভিব্যির মত কথা কও কেন? বলেছিল সত্য। আর তদবধিই যেন সত্য চিন্তামগ্ন।

ছুটির সকালটা দু-দণ্ড রান্নাঘরের দোরে বসে গল্প করেতে কত ভাল লাগে। মনমেজাজ ভাল থাকলে সত্য অপূর্ব! সত্যি বলতে–মনমেজাজ ভাল না থাকলেও কী যে এক আকর্ষণ! নবকুমারকে যেন দড়ি দিয়ে বেঁধে রাখে। নেহাৎ অফিসের সময়টুকু ছাড়া বাড়ি থেকে বেরোতেই ইচ্ছে করে না! তুড়ু-খোকার পড়াটড়াগুলো একটু দেখতে হয়, কারণ মাস্টারমশাই আজকাল নিয়মিত আসেন না। কিন্তু ওই ছাই কর্তব্য কর্মটর্ম তেমন ভাল লাগে না, এক যা বাজার করাটা একটু ভাল লাগে। বাদে ইচ্ছে হয় দুজন মুখোমুখি বসে থাকি। তা হবার জো নেই। সত্যি, সংসার করাটা এত ভারী করে তোলার দরকারটাই বা কি? হাসলাম গল্প করলাম, খেলাম ঘুমোলাম চুকে গেল তা নয়–রাতদিন দশের একজন হবার সাধ কর, ছেলেদের মানুষের মতন মানুষ করে তোলবার চেষ্টা কর, মান মর্যাদা রইল কি গেল তাই ভেবে মাথা খারাপ কর, কেন রে বাবা? গা-দুই ছেড়ে বাসায় এসে তা হলে লাভটা কি হল? আমোদ-আহ্লাদে থাকা যাবে বলেই না আসা?

এই যে সেদিন শুনল আপিসের বন্ধু রামরতনবাবু তার পরিবারকে নিয়ে নাকি থিয়েটার দেখতে গেছল, “নিমাই সন্ন্যাস” পালা, রামরতনের পরিবার নাকি দেখতে দেখতে কেঁদে বুক ভাসিয়েছে, বাড়ি এসে তিনদিন ধরে কেঁদে মরেছে। নবকুমার সত্যকে ধরে পড়েছিল যাবার জন্য, গেল না!

বলল কিনা, এখন মাসের শেষ–হাতের টানাটানি। থিয়েটারে যেতে তো পয়সা লাগবে। তা ছাড়া তুড়ু-খোকাকে নিয়ে সমিস্যে। ওদের দেখবে কে রাত অবধি?

ওদের নিয়ে যাবার কথা তো উড়িয়েই দিল। ছেলেদের ঘোড়দৌড়ের খেলা দেখাতে নিয়ে যেতে চেয়েছিল নবকুমার, তাও বারণ।

কেন যে সত্য এ রকম!

এক যুগ ধরে মনকে এই প্রশ্নই করে চলেছে নবকুমার।

আজ কপালটাই অভাগ্যির।

নিতাইয়ের সঙ্গে দেখা হল না। কোথায় গেছে। তার মেসের এক ভদ্রলোক বললেন, জানি না মশাই, মানুষের সঙ্গে তো মিশতেই চান না নিতাইবাবু। ভাবগতিও তেমন ভাল ঠেকে না আমাদের। চোখে না দেখলে কারুর নামে অপবাদ দিতে নেই, ওঁর পাশের সীটের হারাণবাবু যা বলেছেন তাই বলছি-স্বভাবচরিত্র ভাল নেই নিতাইবাবুর।

অ্যাঁ! কী বললেন!

প্রায় মাটিতেই বসে পড়ে নবকুমার।

এ কী সর্বনেশে সংবাদ!

ভদ্রলোক বললেন, আপনার বিশেষ বন্ধু বুঝি? তবে তো আপনাকে কথাটা বলা আমার ভুল হয়েছে। তবে একরকম ভালও। দেখুন আপনি যদি বুঝিয়ে-সুঝিয়ে সুপথে আনতে পারেন। অবিশ্যি ও পথ থেকে ফেরানো বড় শক্ত কথা।

.

মনের মধ্যে একটা দারুণ যন্ত্রণা নিয়ে ভবতোষ মাস্টারের কাছে যায় নবকুমার। বোধ করি এই প্রথম সে সত্যর নির্দেশ ব্যতীতই একটা কাজ করে ফেলে।

মাস্টার একখানা বই সামনে রেখে উপুড় হয়ে পড়ে তা থেকে খাতায় কি সব লিখে নিচ্ছিলেন, নবকুমার কাছের গোড়ায় বসে পড়ে বিনা ভূমিকায় বলে ফেলে, ভয়ানক একটা বিপদে পড়ে আপনার কাছে এসেছি মাস্টার মশাই!

মাস্টার চমকে ওঠেন।

কী হল? কারুর অসুখবিসুখ নয় তো? সত্যবতী ফেন গালতে পুড়ে যায় নি তো? উঠোনে আছাড় খেয়ে পড়ে যায় নি তো? চকিত হয়ে বলেন, বসে বসো, আগে একটু স্থির হও। ব্যাপারটা কি?

ব্যাপারটা গুরুতর। নিতাইয়ের চরিত্রদোষ ঘটেছে!

কী ঘটেছে নিতাইয়ের?

ঝোঁকের মাথায় কথাটা বলে ফেলেই লজ্জা পায় নবকুমার। এবার মাথাটা চুলকে নীচু গলায় বলে, আজ্ঞে আজ গিয়েছিলাম নিতাইয়ের মেসে, তা দেখা হল না। একজন বলল, নিতাই কোথায় যায় কোথায় না যায় ঠিক নেই, আর–আর তার স্বভাবদোষ ঘটেছে।

ভবতোষ মিনিটখানেক চুপ করে থেকে বলেন, লোকটা নিতাইয়ের শত্রুটত্রু নয় তো?

আজ্ঞে না না। সেরকম কিছু না।

তবে তো সত্যিই বিপদ! ভবতোষ নিজের মনে বিড়বিড় করে বলেন, এই রকম একটা ভয়ই আমার ছিল।

নবকুমার বলে, আজ্ঞে কী বলছেন?

নাঃ, তোমায় কিছু বলি নি।

আপনি একবার তার সঙ্গে দেখা করে বোঝান মাস্টার মশাই।

বোঝাব? ভবতোষ হাসে।

এসব ক্ষেত্রে মাস্টারের বুঝ কোনো কাজে লাগে না নব!

কিন্তু একটা তো কিছু করতে হবে মাস্টারমশাই।

চিরনিস্তেজ নবকুমারের এই ব্যাকুলতা মনকে স্পর্শ করে ভবতোষের। তিনি স্নেহার্দ্র গলায় বলেন, আচ্ছা আমি চেষ্টা করব। তবে কি জান

আজ্ঞে কি বলছেন?

বলছি–মানে বলছিলাম কি, আমার বলার চাইতে অনেক বেশী কাজ হবে যদি বৌমা একবার

বৌমা!

নবকুমার বিমূঢ় নির্বোধ গলায় বলে, কার কথা বলছেন, ইয়ে তুড়ুর মা?

হ্যাঁ, তাই বলছি। উনি যদি একবার নিতাইকে দিব্যি-দিলেশা দিয়ে বলতে পারেন, হয়তো কাজ হতে পারে।

নবকুমার তেমন গলাতেই বলে, আপনি বললে কাজ হবে না, হবে ওর কথায়?

ভবতোষের মুখে রহস্যের জালে আবৃত সূক্ষ্ম একটু হাসির রেখা ফুটে ওঠে। ধীরে বলেন, হলে ওঁর কথাতেই হবে। নচেৎ

তবে তাই বলতে বলব। বলে বিমূঢ় নবকুমার উঠে দাঁড়ায়। তবে মাস্টারের প্রস্তাবটা তার হৃদয়ঙ্গম হয় না। আর সত্যি বলতে কি, ভালও খুব লাগে না। ভাল লাগে না নিতাইয়ের সামনে সত্যকে উপস্থাপিত করার কথাটা। যতই বন্ধু হোক নিতাই, তার যখন স্বভাব খারাপ হয়েছে তখন বিশ্বাস কি? কে জানে মদ-টদও ধরেছে কিনা। মাতাল চরিত্রহীন, এদের কাছ থেকে মেয়েছেলেদের শতহস্ত দূরে থাকা উচিত।

নবকুমারের বাপ নীলাম্বর বাড়ূয্যে নামক ব্যক্তিটিও যে ওইসব অপরাধে অপরাধী এবং চিরদিন তিনি সমাজের মাথার ওপর বাস করে আসছেন, সেটা অবশ্য মনে পড়ে না নবকুমারের।

নিতাইয়ের এই অধঃপতনের খবরটা এবং ভবতোষ মাস্টারের ওই অনাসৃষ্টি প্রস্তাবটা কিভাবে সত্যর কাছে ফেলবে, আর সত্য সেটা কিভাবে নেবে ভাবতে ভাবতে বাড়ি ফেরে।

বেলাও হয়ে গেছে ঢের। সত্য হাঁড়ি নিয়ে বসে আছে। দ্রুত এসে দরজাটায় ধাক্কা দিতে যায় নবকুমার, কিন্তু ধাক্কার আগেই হাত ঠেকাতেই খুলে যায় সেটা। তার মানে আগল দেওয়া ছিল না।

কী কাণ্ড! ভরদুপুরে দোরটা খুলে রেখেছে! বলবে বলে ব্যস্ত হয়ে ঢুকেই দু-পা পিছিয়ে আসে।

দাওয়ার খুঁটির কাছে সত্য একজনের হাত ধরে দাঁড়িয়ে।

<

Ashapurna Devi ।। আশাপূর্ণা দেবী