বাসু ছুটে এসে আমার গলা জড়িয়ে বুকে মুখ লুকালো। তার পরে কেঁদে উঠলো। সে কান্নারও যেমন ভাষা নেই, চিঠিতে সে প্রকাশ করারও তেমনি ভাষা নেই। শিকারের জন্তু মরার আগে তার শেষ নালিশ রেখে যায় যে ভাষায় অনেকটা তেমনি। তাকে কোলে নিয়ে ছুটে পালিয়ে এলুম নিজের ঘরে। সে তেমনি করেই কাঁদতে লাগলো বুকে মুখ রেখে। মনে মনে বললুম, ওরে বাসু, লোকসানের দিক দিয়ে তুই যে বেশী হারালি তা নয়, আর একজনের ক্ষতির মাত্রা তোকেও ছাপিয়ে গেল। তবু তোকে বোঝবার লোক পাবি, কিন্তু সে পাবে না। শুধু একটা আশা বন্দনা যদি বোঝেন।
এমন কতক্ষণ গেল। শেষে চোখ মুছিয়ে দিয়ে বললুম, ভয় নেই রে, মা না থাক, বাপ না থাক কিন্তু রইলুম আমি। ঋণ তাঁদের শোধ দিতে পারবো না, কিন্তু অস্বীকার করবো না কখনো। আজ সবচেয়ে ব্যথা সবচেয়ে ক্ষতির দিনে এই রইলো তোর কাকার শপথ।
কিন্তু এ নিয়ে আর কথা বাড়াবো না, কথার আছেই বা কি। ছেলেবেলায় বাবা বলতেন, গোঁয়ার, মা বলতেন চুয়াড়, কতবার রাগ করেছেন দাদা,—অনাদরে অবহেলায় কতদিন এ বাড়ি হয়ে উঠেছে বিষ, তখন বৌদিদি এসেছেন কাছে, বলেছেন, ঠাকুরপো, কি চাই বলো ত ভাই? রাগ করে জবাব দিয়েছি, কিছুই চাইনে বৌদি, আমি চলে যাবো এখান থেকে।
কবে গো?
আজই।
শুধু হেসে বলেছেন, হুকুম নেই যাবার। যাও ত দেখি আমার অবাধ্য হয়ে।
আর যাওয়া হয়নি। কিন্তু সেই যাবার দিন যখন সত্যি এলো তখন তিনিই গেলেন চলে। ভাবি, কেবল আমার জন্যেই হুকুম? তাঁকে হুকুম করবার কি কেউ ছিল না জগতে?
দাদাকে জিজ্ঞাসা করলুম, কি করে ঘটলো? বললেন, কলকাতাতেই শরীর খারাপ হলো—বোধ হয় মনে মনে খুবই ভাবতো—নিয়ে গেলাম পশ্চিমে। কিন্তু সুবিধে কোথাও হলো না। শেষে হরিদ্বারে পড়লেন জ্বরে, নিয়ে চলে এলাম কাশীতে। সেখানেই মারা গেলেন। ব্যস্!
জিজ্ঞাসা করলুম, চিকিৎসা হয়েছিল দাদা?
বললেন, যথাসম্ভব হয়েছিল।
কিন্তু এই যথাটুকু যে কতটুকু সে দাদা নিজে ছাড়া আর কেউ জানে না।
ইচ্ছে হলো বলি, আমাকে এত বড় শাস্তি দিলেন কেন? কি করেছিলুম আমি? কিন্তু তাঁর মুখের পানে চেয়ে এ প্রশ্ন আর আমার মুখে এলো না।
জিজ্ঞাসা করলুম, তিনি কাউকে কিছু বলে যাননি দাদা?
বলিলেন, হাঁ। মৃত্যুর ঘণ্টা—দশেক পূর্ব পর্যন্ত চেতনা ছিল, জিজ্ঞেসা করলুম, সতী, মাকে কিছু বলবে?
বললে, না।
আমাকে?
না।
দ্বিজুকে?
হাঁ। তাকে আমার আশীর্বাদ দিও। বলো সব রইলো।
উপন্যাস : বিপ্রদাস Chapter : 25 Page: 142
- Details
- Sarat Chandra Chattopadhyay ।। শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
- শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
- Category: বিপ্রদাস
- Read Time: 1 min
- Hits: 175