সাহেব উদ্বিগ্নমুখে প্রশ্ন করিলেন, খায়নি?
না। সকালে সেই যে দুটো ফল খেয়েছিল আর কিছু না।
সাহেব দ্রুতপদে কন্যার ঘরের দরজায় গিয়া ঘা দিলেন,—বুড়ী!
বন্দনা কবাট খুলিয়া দিল। তাহার মুখের প্রতি চাহিয়া পিতা স্তব্ধ হইয়া রহিলেন,—কি হয়েছে রে?
বন্দনা কহিল, বাবা, আজ রাত্রের গাড়িতে আমি বলরামপুরে যাবো।
বলরামপুরে? কেন?
দ্বিজদাসবাবু একখানা চিঠি লিখেছেন,—পড়বে বাবা?
তুই পড় মা, আমি শুনি, বলিয়া সাহেব চৌকি টানিয়া লইয়া বসিলেন। বন্দনা তাঁহাকে ঘেঁষিয়া দাঁড়াইয়া যে চিঠিখানা পড়িয়া শুনাইল তাহা এই—
সুচরিতাসু,
আপনার যাবার দিনটি মনে পড়ে। উঠানে গাড়ি দাঁড়িয়ে, বললেন, মাঝে মাঝে খবর দিতে। বললুম, কুঁড়ে মানুষ আমি, চিঠিপত্র লেখা সহজে আসেও না, ভালো লিখতেও জানিনে। এ ভার বরঞ্চ আর কাউকে দিয়ে যান।
শুনে অবাক হয়ে চেয়ে রইলেন, তারপরে গাড়িতে গিয়ে উঠে বসলেন, দ্বিতীয় অনুরোধ করলেন না। হয়ত ভাবলেন অসৌজন্য যাকে এমন সময়েও একটা ভালো কথা মুখে আনতে দেয় না তাকে আর বলবার কি আছে!
আমি এমনিই বটে। তবু আশা ছিল লিখতেই যদি হয় যেন এমন কিছু লিখতে পারি যা খবরের চেয়ে বড়। সে লেখা যেন অনায়াসে আমার সকল অপরাধের মার্জনা চেয়ে নিতে পারে।
মনে ভাবতুম মানুষের জন্যে কি শুধু অভাবিত দুঃখই আছে, অভাবিত সুখ কি জগতে নেই?
দাদার ইষ্টদেবতা শুধু চোখ বুজেই থাকবেন, চেয়ে কখনো দেখবেন না? অঘটন যা ঘটল সেই হবে চিরস্থায়ী, তাকে টলাবার শক্তি কোথাও নেই?
দেখা গেল নেই,—সে শক্তি কোথাও নেই। না টললেন ভগবান, না টললো তাঁর ভক্ত। নিবাত নিষ্কম্প দীপশিখা আজও তেমনি ঊর্ধ্বমুখে জ্বলচে, জ্যোতিঃর কণামাত্র অপচয়ও ঘটেনি।
এ প্রসঙ্গ কেন তাই বলি। তিন দিন হলো দাদা বাড়ি ফিরে এসেছেন। সকালে যখন গাড়ি থেকে নামলেন তাঁর পিছনে নামলো বাসু। খালি পা, গলায় উত্তরীয়। গাড়ি ফিরে চলে গেলো আর কেউ নামল না। সকালের রোদে ছাদে দাঁড়িয়েছিলুম, চোখের সুমুখে সমস্ত পৃথিবী হয়ে এলো অন্ধকার,—ঠিক অমাবস্যা রাত্রির মতো। বোধ করি মিনিট-দুই হবে, তার পরে আবার সব দেখতে পেলুম, আবার সব স্পষ্ট হয়ে এলো। এমন যে হয় এর আগে আমি জানতুম না।
নীচে নেমে এলুম, দাদা বললেন, তোর বৌদি কাল সকালে মারা গেছেন দ্বিজু। হাতে টাকাকড়ি বিশেষ নেই, সামান্যভাবে তাঁর শ্রাদ্ধের আয়োজন করে দে। মা কোথায়?
ঢাকায় । তাঁর মেয়ের বাড়িতে।
ঢাকায়? একটু চুপ করে থেকে বললেন, কি জানি, আসতে হয়ত পারবেন না, কিন্তু মাতৃদায় জানিয়ে বাসু তাঁকে চিঠি দেয় যেন।
বললুম, দেবে বৈ কি।
উপন্যাস : বিপ্রদাস Chapter : 25 Page: 141
- Details
- Sarat Chandra Chattopadhyay ।। শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
- শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
- Category: বিপ্রদাস
- Read Time: 1 min
- Hits: 161