কিন্তু আমার শুনতে খুব ভালই লাগচে।

কিন্তু কেবল ভাল-লাগাটাই ত সব নয়। পৃথিবীতে আমরাও অত্যন্ত সাধারণ আরও দশজন ত আছি। একটি মাত্র অসাধারণ ব্যক্তিই যদি সমস্ত জায়গা জুড়ে বসে, আমরা যাই কোথা? ভগবান মুখটা ত কেবল পরের স্তব গাইতেই দেননি?

বন্দনা সহাস্যে কহিল, অর্থাৎ দাদাকে ছেড়ে এখন ছোটভাইয়ের একটু স্তব গাইতে চান;—এই ত?

দ্বিজুও হাসিল, কহিল, চাই ত বটে, কিন্তু সুযোগ পাই কোথায়? যারা পরিচিত তারা কান দেবে না, অচেনার কাছেই একটু গুনগুন করা চলে কিন্তু সাহস পাইনে, ভয় হয় অভ্যাসের অভাবে নিজের স্তব নিজের মুখে হয়ত বেধে-বেধে যাবে।

বন্দনা বলিল, না যেতেও পারে, চেষ্টা করে দেখুন। আমার বিশ্বাস পুরুষেরা এ বিদ্যেয় আজন্মসিদ্ধ। আর দেরি করবেন না, আরম্ভ করুন।

দ্বিজু মাথা নাড়িয়া কহিল, না, পেরে উঠব না। তার চেয়ে বরঞ্চ নিরিবিলি বসে দু-চারখানা বই দেখুন, আমি বৌদিকে পাঠিয়ে দিচ্চি। এই বলিয়া সে চলিয়া যাইতে উদ্যত হইতেই বন্দনা জোর দিয়া বলিয়া উঠিল, বেশ ত আপনি! না, একলা ফেলে আমাকে যাবেন না। বই আমি অনেক পড়েচি, তার দরকার নেই। আপনি গল্প করুন আমি শুনি।

কিসের গল্প?

আপনার নিজের।

তা হলে একটু সবুর করুন, আমি এক্ষুনি নীচে গিয়ে ঢের ভাল বক্তা পাঠিয়ে দিচ্চি।

বন্দনা বলিল, পাঠাবেন মেজদিকে ত? তার দরকার নেই। তাঁর বলবার যা-কিছু ছিল চিঠিতেই শেষ হয়ে গেছে। সেগুলো সত্যি কিনা এখন তাই শুনতে চাই।

দ্বিজদাস বলিল, না, সত্যি নয়। অন্ততঃ বারো-আনা মিথ্যে। আচ্ছা, আপনি নাকি শীঘ্রই বিলেতে যাচ্চেন?

বন্দনা বুঝিল, এই লোকটি নিজের প্রসঙ্গ আলোচনা করিতে চায় না এবং জিদ করার মত ঘনিষ্ঠতা অশোভন হইবে। কহিল, বাবার ইচ্ছে তাই। ইস্কুলের বিদ্যেটা তিনি সেখানে গিয়েই শেষ করতে বলেন। আপনিও কেন চলুন না?

দ্বিজদাস বলিল, আমার নিজের আপত্তি নেই, কিন্তু টাকা পাব কোথায়? সেখানে ছেলে পড়িয়েও চলবে না, এবং এত ভার বৌদির ওপরেও চাপাতে পারব না। এ আশা বৃথা।

শুনিয়া বন্দনা হাসিল। কহিল, দ্বিজুবাবু, এ আপনার রাগের কথা। নইলে যে অর্থ আপনাদের আছে তাতে শুধু নিজে নয়, ইচ্ছে করলে এ গ্রামের অর্ধেক লোককে সঙ্গে নিয়ে যেতে পারেন। বেশ, সে ব্যবস্থা আমি করে দিচ্চি, আপনি যাবার জন্য প্রস্তুত হোন।

দ্বিজু কহিল, সে ব্যবস্থা হবার নয়। টাকা প্রচুর আছে সত্যি, কিন্তু সে-সব দাদার, আমার নয়। আমি দয়ার ওপর আছি বললেও অত্যুক্তি হয় না।

বন্দনা পুনরায় হাসিবার চেষ্টা করিয়া কহিল, অত্যুক্তি যে কি এবং কোন্‌টা, সে আমিও বুঝি। কিন্তু এও রাগের কথা। মেজদির চিঠিতে একবার শুনেছিলাম যে, যে সম্পত্তি আপনি নিজে অর্জন করেন নি সে নিতে আপনি অনিচ্ছুক। এ কথা কি ঠিক নয়?

Sarat Chandra Chattopadhyay ।। শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়