দ্বিজদাস বলিল, যদি ঠিকও হয়, সে মানুষের ধর্মবুদ্ধির কথা, রাগের নয়। কিন্তু এ-ই সমস্ত কারণ নয়।
সমস্ত কারণটা কি শুনতে পাইনে?
দ্বিজদাস চুপ করিয়া রহিল। বন্দনা ক্ষণকাল তাহার মুখের পানে চাহিয়া থাকিয়া আস্তে আস্তে বলিল, আমি স্বভাবতঃ এত কৌতূহলী নই এবং আমার এই আগ্রহ যে সৃষ্টিছাড়া আতিশয্য যে বোধ আমারও আছে, কিন্তু বোধ থাকলেই সংসারের সব প্রয়োজন মেটে না—অভাব হাঁ করে চেয়ে থাকে। আপনার কথা আমি এত বেশী শুনেচি যে, আপনি প্রথম যখন ঘরে ঢুকলেন অপরিচিত বলে আপনাকে মনেই হ’ল না, যেন কতবার দেখেচি এমনি সহজে চিনতে পারলুম। মেজদিকে এত কথা বলতে পেরেচেন, আর আমাকে পারেন না? আর কিছু না হোক, তাঁর মত আমিও ত একজন আত্মীয়।
কথা শুনিয়া দ্বিজু অবাক হইয়া গেল। এবং অকস্মাৎ সমস্ত ব্যাপারটা মনে পড়িয়া তাহার সঙ্কোচ ও বিস্ময়ের অবধি রহিল না। সম্পূর্ণ অচেনা বয়স্থা কন্যার সহিত নির্জনে এইভাবে আলাপ করার ইতিহাস এই প্রথম, দেয়ালে ঘড়ির দিকে চাহিয়া দেখিল, একঘণ্টারও উপর কাটিয়া গেছে, ইতিমধ্যে নীচে কেহ যদি তাহাদের খুঁজিয়া থাকে, এ বাটীতে তাহার জবাব যে কি, সে ভাবিয়া পাইল না। হয়ত দাদা বাড়ি ফিরিয়াছেন, হয়ত মায়ের আহ্নিক সারা হইয়াছে,—হঠাৎ সমস্ত দেহ-মন তাহার ব্যাকুল হইয়া যেন একমুহূর্তে সিঁড়ির দিকে ছুটিয়া গেল, কিন্তু কিছুই করিতে না পারিয়া তেমনি স্তব্ধ হইয়া বসিয়া রহিল।
কৈ, বললেন না? বলুন?
দ্বিজুর চমক ভাঙ্গিল। কহিল, যদি বলি, আপনাকেই প্রথম বলব। বৌদিকেও আজও বলিনি।
সে বোঝাপড়া তিনি করবেন। আমি কিন্তু না শুনে,—
বলা যে উচিত নয় এ-সম্বন্ধে দ্বিজুর সংশয় ছিল না, কিন্তু অনুরোধ উপেক্ষা করারও তাহার শক্তি রহিল না।
হতবুদ্ধির মত মিনিট-খানেক চাহিয়া থাকিয়া কহিল, বাবা আমাকে বস্তুতঃ কিছুই দিয়ে যাননি।
বন্দনা চমকিয়া উঠিল, —ইস! মিছে কথা। এ হতেই পারে না।
প্রত্যুত্তরে দ্বিজু মাথা নাড়িয়া শুধু জানাইল, —পারে।
কিন্তু তার কারণ?
বাবার বোধ হয় ধারণা জন্মেছিল, আমাকে দিলে সম্পত্তি তাঁর নষ্ট হয়ে যেতে পারে।
এ ধারণার কোন সত্যিকার হেতু ছিল?
ছিল। আমাকে বাঁচাবার জন্যে একবার তাঁর বহু টাকা নষ্ট হয়ে গেছে।
বন্দনার মনে পড়িল এই ধরনের একটা ইঙ্গিত একবার সতীর চিঠির মধ্যে ছিল। জিজ্ঞাসা করিল, বাবা উইল করে গেছেন?
দ্বিজদাস কহিল, এ শুধু দাদাই জানেন। তিনি বলেন,—না।
বন্দনা নিশ্বাস ফেলিয়া কহিল, তবু রক্ষে। আমি ভেবেচি বুঝি তিনি সত্যিই উইল করে আপনাকে বঞ্চিত করে গেছেন।
দ্বিজদাস কহিল, তাঁর নিজের ইচ্ছের অভাব ছিল না, কিন্তু মনে হয় দাদা করতে দেননি।
দাদা করতে দেননি। আশ্চর্য!
উপন্যাস : বিপ্রদাস Chapter : 5 Page: 15
- Details
- Sarat Chandra Chattopadhyay ।। শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
- শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
- Category: বিপ্রদাস
- Read Time: 1 min
- Hits: 208