বন্দনা বাহিরের লোক, সবেমাত্র পরিচয় হইয়াছে, ইহার সম্মুখে এই-সকল পূর্বকথার আলোচনায় বিপ্রদাস অস্বস্তিবোধ করিতেছিল, কহিল, বললেও তুমি বুঝবে না বন্দনা, তোমার কলেজের ইংরিজি পুঁথির মধ্যে এ-সব তত্ত্ব নেই; তার সঙ্গে মিলিয়ে যাচাই করতে গিয়ে মায়ের কথা তোমার ভারী অদ্ভুত ঠেকবে। এ আলোচনা থাক।
শুনিয়া বন্দনা খুশী হইল না, কহিল, ইংরিজি পুঁথি আপনিও ত কম পড়েন নি মুখুয্যেমশাই, আপনিই বা তবে বোঝেন কি করে?
বিপ্রদাস বলিল, কে বললে মাকে আমরা বুঝি বন্দনা,—বুঝিনে। এ-সব তত্ত্ব শুধু আমার এই মায়ের পুঁথিতেই লেখা আছে—তার ভাষা আলাদা, অক্ষর আলাদা, ব্যাকরণ আলাদা। সে কেবল উনি নিজেই বোঝেন—আর কেউ না। হাঁ মা, যা বলতে এসেছিলে সে ত এখনও বললে না?
বন্দনা বুঝিল এ ইঙ্গিত তাহাকে। কহিল, মা, এ-বেলার রান্নার কথা আপনাকে জিজ্ঞেসা করতে এসেছিলুম—আমি যাই, কিন্তু আপনিও একটু শীঘ্র করে আসুন। সব ভুলে গিয়ে আবার যেন ছেলে কোলে করে বসে থাকবেন না। এই বলিয়া বিপ্রদাসকে সে একটু কটাক্ষ করিয়া চলিয়া গেল।
সে চলিয়া গেলে দয়াময়ীর মুখের পরে দুশ্চিন্তার ছায়া পড়িল, ক্ষণকাল ইতস্ততঃ করিয়া দ্বিধার কণ্ঠে কহিলেন, বিপিন তুই ত খুব ধার্মিক, জানিস ত বাবা, মাকে কখনও ঠকাতে নেই!
বিপ্রদাস বলিল, দোহাই মা, অমন করে তুমি ভূমিকা ক’র না। কি জিজ্ঞাসা করবে কর।
দয়াময়ী কহিলেন, তুই হঠাৎ আজ ও-কথা বললি কেন যে তোরও জেল হতে পারে?
কৈলাসে যাবার সঙ্কল্প এখনও ত্যাগ করিনি বটে, কিন্তু আর ত আমি এক পাও নড়তে পারব না বিপিন।
বিপ্রদাস হাসিয়া ফেলিল, কহিল, কৈলাসে পাঠাতে আমিও ব্যস্ত নই মা, কিন্তু সে দোষ আমার ঘাড়ে শেষকালে যেন চাপিও না। ওটা শুধু একটা দৃষ্টান্ত,—দ্বিজুর কথায় তোমাকে বোঝাতে চেয়েছিলুম যে কেবল জেলে যাবার জন্যই কারও বংশে কলঙ্ক পড়ে না।
দয়াময়ী মাথা নাড়িলেন—ওতে আমি ভুলব না বিপিন। এলোমেলো কথা বলার লোক তুই নয়—হয় কি করেচিস, নয় কি-একটা করার মতলবে আছিস। আমাকে সত্যি করে বল।
বিপ্রদাস কহিল, তোমাকে সত্যি করেই বলচি আমি কিছুই করিনি। কিন্তু মানুষের মনের মধ্যে কত রকমের মতলব আনাগোনা করে তার কি কোন সঠিক নির্দেশ দেওয়া চলে মা?
দয়াময়ী পূর্বের মত মাথা নাড়িয়া বলিলেন, না, তাও না। নইলে তোকে দেখলেই কেন আজকাল আমার এমন মন-কেমন করে? তোকে মানুষ করেচি, আমি বেঁচে থাকতেই শেষকালে এতবড় নেমকহারামি করবি বাবা? বলিতে বলিতেই তাঁহার দুই চোখ জলে পরিপূর্ণ হইয়া গেল।
বিপ্রদাস বিপন্ন হইয়া বলিল, অমঙ্গল কল্পনা করে যদি তুমি মিথ্যে ভয় পাও মা, আমি তার কি প্রতিকার করতে পারি বল? তুমি ত জান তোমার অমতে কখন একটা কাজও আমি করিনে।
উপন্যাস : বিপ্রদাস Chapter : 12 Page: 48
- Details
- Sarat Chandra Chattopadhyay ।। শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
- শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
- Category: বিপ্রদাস
- Read Time: 1 min
- Hits: 191