বন্দনা বলিল, কি আছে আমি জানি। ভাইপো এসেছেন ব্যারিস্টারি পাস করে,—মাসী দিয়েচেন আমাদের আলাপ-পরিচয় করিয়ে। দৃঢ় বিশ্বাস সে-ই আমার যোগ্য বর! কারণ বাবার আমি এক মেয়ে, যে সম্পত্তি তিনি রেখে যাবেন, তার আয়ে উপার্জন না করলেও ভাইপোর অনায়াসে চলে যাবে।

বিপ্রদাস বলিল, ভাইপোর কল্যাণ-চিন্তা করা পিসীর পক্ষ থেকে দোষের নয়। ছেলেটি দেখতে কেমন?

ভালো।

আমার মতো হবে?

বন্দনা হাসিয়া বলিল, এটি হলো আপনার অহঙ্কারের কথা। মনে বেশ জানেন এত রূপ সংসারে আর নেই। কিন্তু সে তুলনা করতে গেলে সংসারে সব মেয়েকেই যে আইবুড়ো থাকতে হয় মুখুয্যেমশাই। কেবল আপনার পানে চেয়েই তাদের দিন কাটাতে হয়। তবু বলবো দেখতে অশোককে ভালই, খুঁতখুঁত করা অন্ততঃ আমার সাজে না!

তা হলে পছন্দ হয়েছে বলো?

যদি হয়েও থাকে, সে পছন্দের কেউ দোষ দেবে না বলতে পারি। এই বলিয়া বন্দনা হাসিয়া উঠিয়া দাঁড়াইল, কহিল, পাঁচটা বাজলো, আপনার বার্লি খাবার সময় হয়েছে—যাই আনি গে। ইতিমধ্যে অশোকের কথাটা আর একটু ভেবে রাখুন, বলিয়া সে চলিয়া গেল। মিনিট-পাঁচেক পরে সে যখন ফিরিয়া আসিল তাহার হাতে রূপার বাটিতে বার্লি—বরফের ভিতর রাখিয়া ঠাণ্ডা করা—নেবুর রস নিঙড়াইয়া দিয়া কহিল, এর সবটুকু খেতে হবে, ফেলে রাখলে চলবে না। সেবার ত্রুটি দেখিয়ে কেউ যে আমার কৈফিয়ত চাইবে সে আমি হতে দেবো না।

বিপ্রদাস বলিল, জুলুমের বিদ্যেটি ষোল আনায় শিক্ষে করে নিয়েচ, কারো কাছে ঠকতে হবে না দেখছি।

বন্দনা বলিল, না। কেউ জিজ্ঞেসা করলে বলবো, মুখুয্যেমশায়ের ওপর হাত পাকিয়ে পাকা হয়ে গেছি।

খাওয়া শেষ হইলে উচ্ছিষ্ট পাত্রটা হাতে করিয়া বন্দনা চলিয়া যাইতেছিল, ফিরিয়া দাঁড়াইয়া জিজ্ঞাসা করিল, আমার একটি কথার জবাব দেবেন মুখুয্যেমশাই?

কি কথা বন্দনা?

সংসারে সকলের চেয়ে আপনাকে কে বেশী ভালোবাসে বলতে পারেন?

পারি।

বলুন ত কি নাম তার?

তার নাম বন্দনা দেবী।

শুনিয়া বন্দনা চক্ষের পলকে বাহির হইয়া গেল। কিন্তু মিনিট-পনেরো পরেই আবার ফিরিয়া আসিয়া বিছানার কাছে একটা চৌকি টানিয়া বসিল। বিপ্রদাস হাসিয়া জিজ্ঞাসা করিল, অমন করে ছুটে পালিয়ে গেলে কেন বলো ত?

বন্দনা প্রথমে জবাব দিতে পারিল না। তারপরে ধীরে ধীরে বলিল, কথাটা হঠাৎ কেমন সইতে পারলুম না মুখুয্যেমশাই। মনে হল যেন আমার কি-একটা বিশ্রী চুরি আপনার কাছে ধরা পড়ে গেছে।

তাই এখনো মুখ তুলে চাইতে পারছো না?

তা কেন পারবো না, বলিয়া জোর করিয়া মুখ তুলিয়া বন্দনা হাসিতে গেল, কিন্তু সলজ্জ শরমে সমস্ত মুখখানি তাহার রাঙ্গা হইয়া উঠিল, পরে আত্মসংবরণ করিতে করিতে বলিল, কি করে আপনি এ কথা জানলেন বলুন ত?

Sarat Chandra Chattopadhyay ।। শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়