চার
আরও ছয় মাস অতীত হইয়া গেল। হরিমতির বিবাহের পূর্বেই ছোটভাই বিযয়সম্পত্তি ভাগ করিয়া লইয়াছিল, নীলাম্বরের নিজের ভাগে যাহা পড়িয়াছিল তাহার কিয়দংশ সেই সময়েই বাঁধা দিয়া অর্থ সংগ্রহ করিতে হইয়াছিল—বলা বাহুল্য, পীতাম্বর এক কপর্দক দিয়াও সাহায্য করে নাই। অবশিষ্ট জমিজমা যাহা ছিল তাহাই একটির পর একটি বন্ধক দিয়া নীলাম্বর বিবাহের শর্ত পালন করিয়া ভগিনীপতির পড়ার খরচ যোগাইতে লাগিল এবং সংসার চালাইতে লাগিল। এইরূপে দিন দিন নিজেকে সে ক্রমাগত শক্ত করিয়া জড়াইয়া ফেলিতে লাগিল, কিন্তু মমতাবশে কোনমতেই পৈতৃক সম্পত্তি একেবারে বিক্রয় করিয়া ফেলিতে পারিল না। আজ বৈকালে ও-পাড়ার ভোলানাথ মুখুয্যে আসিয়া বাকী সুদের জন্য কয়েকটা কথা কড়া করিয়াই বলিয়া গিয়াছিল, আড়ালে দাঁড়াইয়া বিরাজ তাহা সমস্তই শুনিল এবং নীলাম্বর ঘরে আসিতেই, সে রান্নাঘর হইতে নি:শব্দে সম্মুখে আসিয়া দাঁড়াইল। তাহার মুখের পানে চাহিয়াই নীলাম্বর মনে মনে প্রমাদ গণিল। ক্ষোভে অপমানে বিরাজের বুকের ভিতরটা হুহু করিয়া জ্বলিতেছিল। কিন্তু সে ভাব সংযত করিয়া হাত দিয়া খাট দেখাইয়া দিয়া প্রশান্ত-গম্ভীরকন্ঠে বলিল, ঐখানে ব’স।
নীলাম্বর শয্যার উপর বসিতেই সে নীচে পায়ের কাছে বসিয়া পড়িয়া বলিল, হয় আমাকে ঋণমুক্ত কর, না হয়, আজ তোমার পা ছুঁয়ে দিব্যি করব।
নীলাম্বর বুঝিল, সে সমস্ত শুনিয়াছে, তাই অত্যন্ত ভয় পাইয়া তৎক্ষণাৎ ঝুঁকিয়া পড়িয়া তাহার মুখে হাত চাপা দিয়া তাহাকে জোর করিয়া টানিয়া তুলিয়া পাশে বসাইয়া স্নিগ্ধকণ্ঠে বলিল, ছি বিরাজ, সামান্যতেই আত্মহারা হ’সনে।
বিরাজ মুখের উপর হইতে তাহার হাতটা সরাইয়া দিয়া বলিল, এতেও মানুষ আত্মহারা না হয়, কিসে হয় বল শুনি।
নীলাম্বর কি জবাব দিবে হঠাৎ খুঁজিয়া পাইল না, চুপ করিয়া বসিয়া রহিল।
বিরাজ বলিল, চুপ করে রইলে কেন? জবাব দাও।
নীলাম্বর মৃদুকন্ঠে বলিল, জবাব দেবার কিছুই নেই বিরাজ, কিন্তু—
বিরাজ বাধা দিয়া বলিয়া উঠিল, না, কিন্তুতে হবে না। আমার বাড়িতে দাঁড়িয়ে লোকে তোমাকে অপমান করে যাবে, কানে শুনে আমি সহ্য করে থাকব—এ ভরসা মনে ঠাঁই দিও না। হয় তার উপায় কর, না হয় আমি আত্মঘাতী হব।
নীলাম্বর ভয়ে ভয়ে কহিল, একদিনেই কি উপায় করব বিরাজ?
বেশ, দুদিন পরে কি উপায় করবে, তাই আমাকে বুঝিয়ে বল।
নীলাম্বর পুনরায় মৌন হইয়া রহিল।
বিরাজ বলিল, একটা অসম্ভব আশা করে নিজেকে ভুল বুঝিয়ো না—আমার সর্বনাশ ক’রো না! যত দিন যাবে ততই বেশী জড়িয়ে পড়বে, দোহাই তোমার, আমি ভিক্ষে চাইচি—তোমার দুটি পায়ে ধরছি, এই বেলা যা হয় একটা পথ কর।—বলিতে বলিতে তাহার অশ্রুভারে কণ্ঠ রুদ্ধ হইয়া আসিল। ভুলু মুখুয্যের কথাগুলো তাহার বুকের ভিতরে শূল হানিতে লাগিল।
নীলাম্বর হাত দিয়া তাহার চোখ মুছাইয়া দিয়া ধীরে ধীরে বলিল, অধীর হলে কি হবে বিরাজ? একটা বছর যদি ষোল আনা ফসল পাই, বার আনা বিষয় উদ্ধার করে নিতে পারব। কিন্তু বিক্রি করে ফেললে আর ত হবে না সেটা ভেবে দেখ!
বিরাজ আর্দ্রস্বরে বলিল, দেখচি; আসচে বছরেই যে ষোল আনা ফসল পাবে, তারই বা ঠিকানা কি? তার ওপর সুদ আছে, লোকের গঞ্জনা আছে। আমি সব দুঃখ সইতে পারি, কিন্তু তোমার অপমান ত সইতে পারিনে।
উপন্যাস : বিরাজবউ Chapter : 4 Page: 14
- Details
- Sarat Chandra Chattopadhyay ।। শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
- শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
- Category: বিরাজবউ
- Read Time: 1 min
- Hits: 173