আপনাদের জন্যেই অপেক্ষা করে আছি। আপনারা চলে আসার পরেই আশুবাবুর বাড়ি থেকে লোক গিয়েছিল আপনাকে খুঁজতে। এই বলিয়া সে কমলের প্রতি চাহিল।
কমল কহিল, আমাকে খুঁজতে যাবার হেতু?
লোকটি কহিল, আপনি বোধ হয় শুনেচেন চারিদিকে অত্যন্ত ইনফ্লুয়েঞ্জা হচ্চে এবং অনেক ক্ষেত্রেই মারা যাচ্চে। শিবনাথবাবু অতিশয় পীড়িত। হঠাৎ ডুলি করে তাঁকে আশুবাবুর বাড়িতে নিয়ে এসেছে। আশুবাবু ভেবেছিলেন আপনি আশ্রমে আছেন, তাই ডাকতে পাঠিয়েছিলেন।
রাত এখন কত?
বোধ হয় তিনটে বেজে গেছে।
কমল হাত বাড়াইয়া গাড়ির দরজা খুলিয়া দিয়া কহিল, ভিতরে আসুন, পথে আপনাদের আশ্রমে পৌঁছে দিয়ে যাব।
অজিত একটা কথাও কহিল না। কাঠের পুতুলের মত নিঃশব্দে গাড়ি চালাইয়া হরেন্দ্রের বাসার সম্মুখে আসিয়া থামিল। রাজেন অবতরণ করিলে কমল কহিল, আপনাকে ধন্যবাদ। আমাকে খবর দেবার জন্যে আজ আপনি অনেক দুঃখ ভোগ করলেন।
এ আমার কাজ। প্রয়োজন হলেই সংবাদ দেবেন। এই বলিয়া সে চলিয়া গেল। ভূমিকা নাই, আড়ম্বর নাই, সাদা কথায় জানাইয়া গেল—এ তাহার কর্তব্যের অন্তর্গত। আজই সন্ধ্যাকালে হরেন্দ্রের মুখে এই ছেলেটির সম্বন্ধে যতকিছু সে শুনিয়াছিল সমস্তই মনে পড়িল। একদিকে তাহার একজামিন পাস করিবার অসাধারণ দক্ষতা, আর একদিকে সফলতার মুখে তাহা ত্যাগ করিবার অপরিসীম ঔদাসীন্য। বয়স তাহার অল্প, সবেমাত্র যৌবনে পা দিয়াছে, এই বয়সেই নিজের বলিয়া কিছুই হাতে রাখে নাই, পরের কাজে বিলাইয়া দিয়াছে।
অজিত সেই অবধি নীরব হইয়া ছিল। রাত্রি তিনটা বাজিয়া গেছে শোনার পরে কোনকিছুতে মন দেবার শক্তি আর তাহার ছিল না। শুধু একটা কাল্পনিক, অসংবদ্ধ প্রশ্নোত্তরমালার আঘাত-অভিঘাতের নীচে এই নিশীথ অভিযানের নিরবচ্ছিন্ন কুশ্রীতায় অন্তর তাহার কালো হইয়া রহিল। খুব সম্ভব, কেহই কিছু জিজ্ঞাসা করিবে না, হয়ত জিজ্ঞাসা করিবার ভরসাও কেহ পাইবে না, শুধু আপন আপন ইচ্ছা, অভিরুচি ও বিদ্বেষের তুলি দিয়া অজ্ঞাত ঘটনার আদ্যোপান্ত কাহিনী বর্ণে বর্ণে সৃজন করিয়া লইবে। আর ইহার চেয়েও বেশী ব্যাকুল করিয়াছিল তাহাকে এই লজ্জাহীনা মেয়েটার নির্ভয় সত্যবাদিতা। এ জগতে মিথ্যা বলার ইহার প্রয়োজন নাই। এ যেন পৃথিবীসুদ্ধ সকলকে শুধু অপমান করা।
এদিকে শিবনাথের পীড়ার উপলক্ষে কে এবং কাহারা উপস্থিত হইয়াছে সে জানে না। এই মেয়েটিকে তাঁহারা প্রশ্ন করিতেছেন মনে করিয়াও অজিতের গায়ের রক্ত শীতল হইয়া আসিল। হঠাৎ তাহার মনে হইল, কমলকে সে ঘৃণা করে এবং ইহারই লুব্ধ আশ্বাসে সে যে আত্মবিস্মৃত উন্মাদের ন্যায় মুহূর্তের জন্যও জ্ঞান হারাইয়াছে ইহার কঠিন শাস্তি যেন তাহার হয়, এই বলিয়া সে বার বার করিয়া আপনাকে আপনি অভিশাপ দিল।
গেটের মধ্যে প্রবেশ করিয়াই তাহার চোখে পড়িল সম্মুখের খোলা জানালায় দাঁড়াইয়া আশুবাবু স্বয়ং। বোধ হয় তাহারই প্রতীক্ষায় উদ্গ্রীব হইয়া আছেন। গাড়ির শব্দে নীচে চাহিয়া বলিলেন, অজিত এলে? সঙ্গে কে, কমল?
উপন্যাস : শেষ প্রশ্ন Chapter : 15 Page: 96
- Details
- Sarat Chandra Chattopadhyay ।। শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
- শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
- Category: শেষ প্রশ্ন
- Read Time: 1 min
- Hits: 163