নীলিমা কি-একটা সেলাই করছিল, ভাল-মন্দ কোন সাড়া পাইনে দেখে মুখ তুলে চেয়ে দেখি তার হাতের সেলাইটা মাটিতে পড়ে গেছে, মাথাটা চৌকির বাজুতে লুটিয়ে পড়েচে, চোখ বোজা, মুখখানা একেবারে ছাইয়ের মত সাদা। কি যে হ’লো হঠাৎ ভেবে পেলাম না। তাড়াতাড়ি উঠে মেঝেতে শোয়ালাম, গ্লাসে জল ছিল—চোখেমুখে ঝাপটা দিলাম, পাখার অভাবে খবরের কাগজটা দিয়ে বাতাস করতে লাগলাম,—চাকরটাকে ডাকতে গেলাম, গলা দিয়ে আওয়াজ বেরুলো না। বোধ করি মিনিট দুই-তিনের বেশী নয়, সে চোখ চেয়ে শশব্যস্তে উঠে বসলো, একবার সমস্ত দেহটা তার কেঁপে উঠল, তারপরে উপুড় হয়ে আমার কোলের ওপর মুখ চেপে হুহু করে কেঁদে উঠল। সে কি কান্না! মনে হলো বুঝি তার বুক ফেটে যায় বা! অনেকক্ষণ পরে তুলে বসালাম,—কতদিনের কত কথা, কত ঘটনাই মনে পড়ল,—আমার বুঝতে কিছুই বাকী রইল না।
কমল নিঃশব্দে তাঁহার মুখের পানে চাহিল।
আশুবাবু একমুহূর্ত নিজেকে সংবরণ করিয়া বলিলেন, খুব সম্ভব মিনিট দুই-তিন। এ অবস্থায় তারে কি যে বলব আমি ভেবে পাবার আগেই নীলিমা তীরের মত উঠে দাঁড়াল, একবার চাইলেও না,—ঘর থেকে বার হয়ে গেল। না বললে সে একটা কথা, না বললাম আমি। তার পরে আর দেখা হয়নি।
কমল জিজ্ঞাসা করিল, এ কি আপনি আগে বুঝতে পারেন নি?
আশুবাবু বলিলেন, না। স্বপ্নেও ভাবিনি। আর কেউ হলে সন্দেহ হতো এ শুধু ছলনা,—শুধু স্বার্থ। কিন্তু এঁর সম্বন্ধে এমন কথা ভাবাও অপরাধ। এ কি আশ্চর্য মেয়েদর মন! এই রোগাতুর জীর্ণদেহ, এই অক্ষম অবসন্নচিত্ত, এই জীবনের অপরাহ্নবেলায় জীবনের দাম যার কানাকড়িও নয়, তারও প্রতি যে সুন্দরী যুবতীর মন আকৃষ্ট হতে পারে, এতবড় বিস্ময় জগতে কি আছে! অথচ, এ সত্য, এর এতটুকুও মিথ্যে নয়। এই বলিয়া এই সদাচারী প্রৌঢ় মানুষটি ক্ষোভে, বেদনায় ও অকপট লজ্জায় নিশ্বাস ফেলিয়া নীরব হইলেন। কিছুক্ষণ এইভাবে থাকিয়া পুনশ্চ কহিলেন, কিন্তু আমি নিশ্চয় জানি এই বুদ্ধিমতী নারী আমার কাছে কিছুই প্রত্যাশা করে না। ও শুধু চায় আমাকে যত্ন করতে,শুধু চায় সেবার অভাবে জীবনের নিঃসঙ্গ বাকী দিন-কটা যেন না আমার দুঃখে শেষ হয়। শুধু দয়া আর অকৃত্রিম করুণা!
কমল চুপ করিয়া আছে দেখিয়া তিনি বলিতে লাগিলেন, বেলা বিবাহ-বিচ্ছেদের যখন মামলা আনে আমি সম্মতি দিয়েছিলাম। কথায় কথায় সেদিন এই প্রসঙ্গ উঠে পড়ায় নীলিমা অত্যন্ত রাগ করেছিল। তারপর থেকে বেলাকে ও যেন কিছুতেই সহ্য করতে পারছিল না। নিজের স্বামীকে এমনি করে সর্বসাধারণের কাছে লজ্জিত অপদস্থ করে এই প্রতিহিংসার ব্যাপারটা নীলিমা কিছুতেই অন্তরে মেনে নিতে পারলে না। ও বলে, তাঁকে ত্যাগ করাটাই ত বড় নয়, তাঁকে ফিরে পাবার সাধনাই স্ত্রীর পরম সার্থকতা। অপমানের শোধ নেওয়াতেই স্ত্রীর সত্যকার মর্যাদা নষ্ট হয়, নইলে ও ত কষ্টিপাথর, ওতে যাচাই করেই ভালবাসার মূল্য ধার্য হয়। আর এ কেমনতর আত্মসম্মান-জ্ঞান? যাকে অসম্মানে দূর করেছি, তারই কাছে হাত পেতে নেওয়া নিজের খাওয়া-পরার দাম? কেন, গলায় দেবার দড়ি জুটলো না? শুনে আমি ভাবতাম নীলিমার এ অন্যায়,—এ বাড়াবাড়ি।
উপন্যাস : শেষ প্রশ্ন Chapter : 26 Page: 194
- Details
- Sarat Chandra Chattopadhyay ।। শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
- শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
- Category: শেষ প্রশ্ন
- Read Time: 1 min
- Hits: 153