ভেবেচি, এবার তোমাকে ঠাঁই দিতে বলব, না পাই মরব। পুরুষের কৃপা ভিক্ষে চেয়ে স্রোতের আবর্জনার মত আর ঘাটে ঘাটে ঠেকতে ঠেকতে আয়ুর শেষ দিনটা পর্যন্ত অপেক্ষা করতে পারবো না। বলিতে বলিতে তাহার গলার স্বরটা ভারী হইয়া আসিল, কিন্তু চোখের জল জোর করিয়া দমন করিয়া রাখিল।

কমল তাহার মুখের পানে চাহিয়া শুধু একটু হাসিল।

হাসলে যে?

হাসাটা জবাব দেওয়ার চেয়ে সহজ বলে।

নীলিমা বলিল, সে জানি। কিন্তু আজকাল মাঝে মাঝে কোথায় যে অদৃশ্য হয়ে যাও, সেই ত আমার ভয়।

কমল কহিল, হলাম বা অদৃশ্য। কিন্তু দরকার হলে আমাকে খুঁজতে যেতে হবে না দিদি, আমিই পৃথিবীময় আপনাকে খুঁজে বেড়াতে বার হবো। এ সম্বন্ধে নিশ্চিন্ত হোন।

আশুবাবু কহিলেন, এবার এমনি করে আমাকেও অভয় দাও কমল, আমিও যেন ওঁর মতই নিঃসংশয় হতে পারি।

আদেশ করুন আমি কি করতে পারি।

তোমাকে কিছুই করতে হবে না কমল, যা করবার আমি নিজেই করব। আমাকে শুধু এইটুকু উপদেশ দাও, পিতার কর্তব্যে অপরাধ না করি। এ বিবাহে কেবল যে মত দিতে পারিনে তাই নয়, ঘটতে দিতেও পারিনে।

কমল বলিল, মত আপনার, না দিতেও পারেন। কিন্তু বিবাহ ঘটতে দেবেন না কি করে? মেয়ে ত আপনার বড় হয়েছে।

আশুবাবু উত্তেজনা চাপিতে পারিলেন না, কারণ, অস্বীকার করার জো নাই বলিয়া এই কথাটাই মনের মধ্যে তাঁহার অহর্নিশি পাক খাইয়াছে। বলিলেন, তা জানি, কিন্তু মেয়েরও জানা চাই যে বাপের চেয়ে বড় হয়ে ওঠা যায় না। শুধু মতামতটাই আমার নিজের নয় কমল, সম্পত্তিটাও নিজের। আশুবদ্যির দুর্বলতার পরিচয়টাই লোকের অভ্যাস হয়ে গেছে, কিন্তু তার আরও একটা দিক আছে,—সেটা লোকে ভুলেছে।

কমল তাঁহার মুখের পানে চাহিয়া স্নিগ্ধকণ্ঠে বলিল, আপনার সে দিকটা যেন লোকে ভুলেই থাকে আশুবাবু। কিন্তু তাও যদি না হয়, সে পরিচয়টা কি সর্বাগ্রে দিতে হবে নিজের মেয়ের কাছেই?

হাঁ, অবাধ্য মেয়ের কাছে। এই বলিয়া তিনি একমুহূর্ত নীরব থাকিয়া বলিলেন, মা-মরা আমার ঐ একমাত্র সন্তান, কি করে মানুষ করেছি সে শুধু তিনিই জানেন যিনি পিতৃহৃদয় সৃষ্টি করেছেন। এর ব্যথা যে কি তা মুখে ব্যক্ত করতে গেলে তার বিকৃতি কেবল আমাকে নয়, সকল পিতার পিতা যিনি, তাঁকে পর্যন্ত উপহাস করবে। তা ছাড়া তুমি বুঝবেই বা কি করে? কিন্তু পিতার স্নেহই ত শুধু নয়, কমল, তার কর্তব্যও ত আছে? শিবনাথকে আমি চিনতে পেরেছি। তার সর্বনেশে গ্রাস থেকে মেয়েকে রক্ষে করতে পারি এ-ছাড়া আর কোন পথই আমার চোখে পড়ে না। কাল তাদের চিঠি লিখে জানাবো, এর পরে মণি যেন না আমার কাছে একটি কপর্দকও আশা করে।

কিন্তু এ চিঠি যদি তারা বিশ্বাস করতে না পারে? যদি ভাবে এ রাগ বাবার বেশী দিন থাকবে না,—সেদিন নিজের অবিচার তিনি নিজেই সংশোধন করবেন, তা হলে?

তা হলে তারা তার ফল ভোগ করবে। লেখার দায়িত্ব আমার, কিন্তু বিশ্বাস করার দায়িত্ব তাদের।

এই কি আপনি সত্যিই স্থির করেচেন?

হ্যাঁ।

Sarat Chandra Chattopadhyay ।। শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়