আট
দিন-পনেরো পরের কথা। সন্ধ্যা হইতে বিলম্ব নাই, অজিত আশুবাবু ও মনোরমাকে অবিনাশবাবুর বাটীতে নামাইয়া দিয়া একাকী ভ্রমণে বাহির হইয়াছিল। এমন সে প্রায়ই করিত। যে পথটা শহরের উত্তর হইতে আসিয়া কলেজের সম্মুখ দিয়া কিছুদূর পর্যন্ত গিয়া সোজা পশ্চিমে চলিয়া গিয়াছে তাহারই একটা নিরালা জায়গায় সহসা উচ্চ নারীকণ্ঠে নিজের নাম শুনিয়া অজিত চমকিয়া গাড়ি থামাইয়া দেখিল, শিবনাথের স্ত্রী কমল। পথের ধারে ভাঙ্গাচোরা পুরাতন কালের একটা দ্বিতল বাড়ি, সুমুখে একটুখানি তেমনি শ্রীহীন ফুলের বাগান,—তাহারই একধারে দাঁড়াইয়া কমল হাত তুলিয়া ডাকিতেছে। মোটর থামিতে সে কাছে আসিল, কহিল, আর একদিন আপনি এমনি একলা যাচ্ছিলেন, আমি কত ডাকলাম, কিন্তু শুনতে পেলেন না। পাবেন কি করে? বাপ্ রে বাপ্! যে জোরে যান,—দেখলে মনে হয় যেন দম বন্ধ হয়ে যাবে। আপনার ভয় করে না?
অজিত গাড়ি হইতে নীচে নামিয়া দাঁড়াইল, কহিল, আপনি একলা যে? শিবনাথবাবু কৈ?
কমল বলিল, তিনি বাড়ি নেই। কিন্তু আপনিই বা একাকী বেরিয়েছেন কেন? সেদিনও দেখেছিলাম সঙ্গে কেউ ছিল না।
অজিত কহিল, না। এ কয়দিন আশুবাবুর শরীর ভাল ছিল না, তাই তাঁরা কেউ বার হননি। আজ তাঁদের অবিনাশবাবুর ওখানে নামিয়ে দিয়ে আমি বেড়াতে বেরিয়েছি। সন্ধ্যাবেলা কিছুতেই আমি ঘরে থাকতে পারিনে।
কমল কহিল, আমিও না। কিন্তু পারিনে বললেই ত হয় না,—গরীবদের অনেক কিছুই সংসারে পারতে হয়। এই বলিয়া সে অজিতের মুখের পানে চাহিয়া হঠাৎ বলিয়া উঠিল, নেবেন আমাকে সঙ্গে করে? একটুখানি ঘুরে আসবো।
অজিত মুশকিলে পড়িল। সঙ্গে আজ সোফার পর্যন্ত ছিল না, শিবনাথবাবুও গৃহে নাই তাহা পূর্বেই শুনিয়াছে, কিন্তু প্রত্যাখ্যান করিতেও বাধিল। একটুখানি দ্বিধা করিয়া কহিল, এখানে আপনার সঙ্গী-সাথী বুঝি কেউ নেই?
কমল কহিল, শোন কথা! সঙ্গী-সাথী পাব কোথায়? দেখুন না চেয়ে একবার পল্লীর দশা। শহরের বাইরে বললেই হয়,—সাহগঞ্জ না কি নাম, কোথাও কাছাকাছি বোধ করি একটা চামড়ার কারখানা আছে,—আমার প্রতিবেশী ত শুধু মুচিরা। কারখানায় যায় আসে, মদ খায়, সারা রাত হল্লা করে,—এই ত আমার পাড়া।
অজিত জিজ্ঞাসা করিল, এদিকে ভদ্রলোক বুঝি নেই?
কমল বলিল, বোধ হয় না। আর থাকলেই বা কি—আমাকে তারা বাড়িতে যেতে দেবে কেন? তা হলে ত,—মাঝে মাঝে যখন বড্ড একলা মনে হয়,—তখন আপনাদের ওখানেও যেতে পারতাম। বলিতে বলিতে সে গাড়ির খোলা দরজা দিয়া নিজেই ভিতরে গিয়া বসিল; কহিল, আসুন, আমি অনেকদিন মোটরে চড়িনি। আজ কিন্তু আমাকে অনেকদূর পর্যন্ত বেড়িয়ে আনতে হবে।
উপন্যাস : শেষ প্রশ্ন Chapter : 8 Page: 40
- Details
- Sarat Chandra Chattopadhyay ।। শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
- শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
- Category: শেষ প্রশ্ন
- Read Time: 1 min
- Hits: 166