মেয়েদের মুক্তি, মেয়েদের স্বাধীনতা ত আজকাল নরনারীর মুখে মুখে, কিন্তু ঐ মুখের বেশী আর এক-পা এগোয় না। কেন জানেন? এখন দেখতে পেয়েচি স্বাধীনতা তত্ত্ব-বিচারে মেলে না, ন্যায়-ধর্মের দোহাই পেড়ে মেলে না, সভায় দাঁড়িয়ে দল বেঁধে পুরুষের সঙ্গে কোঁদল করে মেলে না,—এ কেউ কাউকে দিতে পারে না,—দেনা-পাওনার বস্তুই এ নয়। কমলকে দেখলেই দেখা যায়, এ নিজের পূর্ণতায়, আত্মার আপন বিস্তারে আপনি আসে। বাইরে থেকে ডিমের খোলা ঠুকরে ভিতরের জীবকে মুক্তি দিলে সে মুক্তি পায় না,—মরে। আমাদের সঙ্গে তার তফাত ঐখানে।

বেলাকে কহিল, এই যে সে দশ-বারোদিন কোথায় চলে গেল, সকলের ভয়ের সীমা রইল না, কিন্তু এ আশঙ্কা কারও স্বপ্নেও উদয় হলো না যে, এমন কিছু কাজ কমল করতে পারে যাতে তার মর্যাদা হানি হয়। বলুন ত, মানুষের মনে এতখানি বিশ্বাসের জোর আমরা হলে পেতাম কোথায়? এ গৌরব আমাদের দিত কে? পুরুষেও না, মেয়েরাও না।

আশুবাবু সবিস্ময়ে তাহার মুখের প্রতি ক্ষণকাল চাহিয়া থাকিয়া বলিলেন, বাস্তবিকই সত্যি নীলিমা।

বেলা প্রশ্ন করিল, কিন্তু তার স্বামী থাকলে সে কি করত?

নীলিমা বলিল, তাঁর সেবা করতো, রাঁধতো-বাড়তো, ঘর-দোর পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করতো, ছেলে হলে তাদের মানুষ করতো; বস্তুতঃ একলা মানুষ, টাকাকড়ি কম, আমার বোধ হয় সময়ের অভাবে তখন আমাদের সঙ্গে হয়ত একবার দেখা করতেও পারতো না।

বেলা কহিল, তবে?

নীলিমা বলিল, তবে কি? বলিয়াই হাসিয়া ফেলিয়া কহিল, কাজকর্ম করব না, শোক-দুঃখ, অভাব-অভিযোগ থাকবে না, হরদম ঘুরে বেড়াবো এই কি মেয়েদের স্বাধীনতার মানদণ্ড নাকি? স্বয়ং বিধাতার ত কাজের অবধি নেই, কিন্তু কেউ কি তাঁকে পরাধীন ভাবে নাকি? এই সংসারে আমার নিজের খাটুনিই কি সামান্য?

আশুবাবু গভীর বিস্ময়ে মুগ্ধচক্ষে তাহার প্রতি চাহিয়া রহিলেন। বস্তুতঃ এই ধরনের কোন কথা এতদিন তাহার মুখে তিনি শোনেন নাই।

নীলিমা বলিতে লাগিল, কমল বসে থাকতে ত জানে না, তখন স্বামী-পুত্র-সংসার নিয়ে সে কর্মের মধ্যে একেবারে তলিয়ে যেতো—আনন্দের ধারার মত সংসার তার ওপর দিয়ে বয়ে যেতো—ও টেরও পেতো না। কিন্তু যেদিন বুঝতো স্বামীর কাজ বোঝা হয়ে তার ঘাড়ে চেপেচে, আমি দিব্যি করে বলতে পারি, কেউ একটা দিনও সে-সংসারে তাকে ধরে রাখতে পারত না।

আশুবাবু আস্তে আস্তে বলিলেন,—তাই বটে, তাই মনে হয়।

অদূরে পরিচিত মোটরের হর্নের আওয়াজ শোনা গেল। বেলা জানালা দিয়া মুখ বাড়াইয়া দেখিয়া কহিল, হাঁ, আমাদেরই গাড়ি।

অনতিকাল পরে ভৃত্য আলো দিতে আসিয়া কমলের আগমন-সংবাদ দিল।

কয়দিন যাবৎ আশুবাবু এই প্রতীক্ষা করিয়াই ছিলেন, অথচ খবর পাওয়া মাত্র তাঁহার মুখ অতিশয় ম্লান ও গম্ভীর হইয়া উঠিল। এইমাত্র আরাম-কেদারায় সোজা হইয়া বসিয়াছিলেন, পুনরায় হেলান দিয়া শুইয়া পড়িলেন।

Sarat Chandra Chattopadhyay ।। শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়