হরেন্দ্র বলিতে লাগিল, অথচ নিজের মধ্যে এমনি একটি নির্দ্বন্দ্ব সংযম, নীরব মিতাচার ও নির্বিশঙ্ক তিতিক্ষা আছে যে, দেখে বিস্ময় লাগে। আপনার শিবনাথের ব্যাপারটা মনে আছে আশুবাবু? সে আমাদের কে, তবুও এতবড় অন্যায় সহ্য হলো না, দণ্ড দেবার আকাঙ্ক্ষায় বুকের মধ্যে যেন আগুন ধরে গেল। কিন্তু কমল বললে, না। তার সেদিনের মুখের চেহারা আমার স্পষ্ট মনে আছে। সে ‘না’-র মধ্যে বিদ্বেষ নেই, জ্বালা নেই, উপর থেকে হাত বাড়িয়ে দান করবার শ্লাঘা নেই, ক্ষমার দম্ভ নেই—দাক্ষিণ্য যেন অবিকৃত করুণায় ভরা। শিবনাথ যত অন্যায়ই করে থাক, আমার প্রস্তাবে কমল চমকে উঠে শুধু বললে, ছি ছি—না না, সে হয় না। অর্থাৎ একদিন যাকে সে ভালবেসেছিল তার প্রতি নির্মমতার হীনতা কমল ভাবতেই পারলে না এবং সকলের চোখের আড়ালে সব দোষ তার নিঃশব্দে নিঃশেষ করে মুছে ফেলে দিলে। চেষ্টা নয়, চঞ্চলতা নয়, শোকাচ্ছন্ন হা-হুতাশ নয়,—যেন পাহাড় থেকে জলের ধারা অবলীলাক্রমে নিচে গড়িয়ে বয়ে গেল।
আশুবাবু নিশ্বাস ফেলিয়া কেবল বলিলেন, সত্যি কথা।
হরেন্দ্র বলিতে লাগিল, কিন্তু আমার সবচেয়ে রাগ হয় ও যখন শুধু কেবল আমার নিজের আইডিয়ালটাকেই নয়, আমাদের ধর্ম, ঐতিহ্য, রীতি, নৈতিক-অনুশাসন, সব কিছুকেই উপহাস করে উড়িয়ে দিতে চায়। বুঝি, ওর দেহের মধ্যে উৎকট বিদেশী রক্ত, মনের মধ্যে তেমনি উগ্র পরধর্মের ভাব বয়ে যাচ্ছে, তবুও ওর মুখের সামনে দাঁড়িয়ে জবাব দিতে পারিনে। ওর বলার মধ্যে কি যে একটা সুনিশ্চিত জোরের দীপ্তি ফুটে বার হতে থাকে যে, মনে হয় যেন ও জীবনের মানে খুঁজে পেয়েচে। শিক্ষা দ্বারা নয়, অনুভব-উপলব্ধি দিয়ে নয়, যেন চোখ দিয়ে অর্থটাকে সোজা দেখতে পাচ্চে।
আশুবাবু খুশী হইয়া বলিলেন, ঠিক এই জিনিসটি আমারও অনেকবার মনে হয়েছে। তাই ওর যেমন কথা, তেমনি কাজ। ও যদি মিথ্যে বুঝেও থাকে, তবু সে মিথ্যের গৌরব আছে। একটু থামিয়া বলিলেন, দেখ হরেন, এ একপ্রকার ভালই হয়েছে যে, পাষণ্ড চলে গেছে। ওকে চিরদিন আচ্ছন্ন করে থাকলে ন্যায়ের মর্যাদা থাকতো না। শুয়োরের গলায় মুক্তোর মালার মত অপরাধ হতো।
হরেন্দ্র বলিল, আবার আর একদিকে এমনি মায়া-মমতা যে, একা বৌদি ছাড়া কোন মেয়েকে তার সমান দেখিনি। সেবায় যেন লক্ষ্মী। হয়ত, পুরুষদের চেয়ে অনেকদিকে অনেক বড় বলেই নিজেকে তাদের কাছে এমনি সামান্য করে রাখে যে, সে এক আশ্চর্য ব্যাপার। মন গলে গিয়ে যেন পায়ে পড়তে চায়।
নীলিমা সহাস্যে কহিল, ঠাকুরপো, তুমি বোধ হয় পূর্বজন্মে কোন রাজরানীর স্তুতিপাঠক ছিলে, এ জন্মে তার সংস্কার ঘোচেনি। ছেলে-পড়ানো ছেড়ে এ ব্যবসা ধরলে যে ঢের সুরাহা হতো।
হরেন্দ্র হাসিল, কহিল, কি করব বৌদি, আমি সরল সোজা মানুষ, যা ভাবি তাই বলে ফেলি। কিন্তু জিজ্ঞেসা করুন দিকি অজিতবাবুকে, এক্ষুণি উনি হাতের আস্তিন গুটিয়ে মারতে উদ্যত হবেন। তা হোক, কিন্তু বেঁচে থাকলে দেখতে পাবেন একদিন।
অজিত ক্রুদ্ধকণ্ঠে বলিয়া উঠিল, আঃ, কি করেন হরেনবাবু! আপনার আশ্রম থেকে দেখচি চলে যেতে হবে একদিন।
উপন্যাস : শেষ প্রশ্ন Chapter : 23 Page: 160
- Details
- Sarat Chandra Chattopadhyay ।। শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
- শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
- Category: শেষ প্রশ্ন
- Read Time: 1 min
- Hits: 173