কিন্তু প্রাসঙ্গিক অংশে যেটুকু, তাহা অচিরে প্রকাশ হইয়া পড়িল। বর-পক্ষ হাতে হাতে ধরা পড়িলেন এবং কন্যাপক্ষ বিবাহ-বিচ্ছেদের মামলা রুজু করিতে চাহিলেন। বন্ধু-মহলে আপসের চেষ্টা হইল, কিন্তু শিক্ষিতা বেলা নর-নারীর সমানাধিকার-তত্ত্বের বড় পাণ্ডা, এই অসম্মানের প্রস্তাবে সে কর্ণপাত করিল না। স্বামী-বেচারা চরিত্রের দিক দিয়া যাই হোক, মানুষ হিসাবে মন্দ লোক ছিল না, স্ত্রীকে সে শক্তি এবং সাধ্যমত ভালই বাসিত। অপরাধ সলজ্জে স্বীকার করিয়া আদালতের দুর্গতি হইতে নিষ্কৃতি দিতে করজোড়ে প্রার্থনা করিল, কিন্তু স্ত্রী ক্ষমা করিল না। শেষে বহুদুঃখে নিষ্পত্তি একটা হইল। নগদে ও গ্রাসাচ্ছাদনের মাসিক বরাদ্দে অনেক টাকা ঘাড় পাতিয়া লইয়া সে মামলার দায় হইতে রক্ষা পাইল এবং দাম্পত্য-যুদ্ধে জয়লাভ করিয়া বেলা ভাঙা-স্বাস্থ্য জোড়া দিতে সিমলা, মুসৌরি, নইনি প্রভৃতি পবর্তাঞ্চলে সদর্পে প্রস্থান করিল। সে আজ প্রায় ছয়-সাত বৎসরের কথা। ইহার অনতিকাল পরেই তাহার পিতার মৃত্যু হয়। এই ব্যাপারে তাঁহার সম্মতি ত ছিলই না, বরঞ্চ অতিশয় মর্মপীড়া ভোগ করিয়াছিলেন। আশুবাবুর পরলোকগত পত্নীর সহিত তাঁহার কি একটা দূর-সম্পর্ক ছিল; সেই সম্বন্ধেই বেলা আশুবাবুর আত্মীয়া। তাহার বিবাহ-উপলক্ষেও নিমন্ত্রিত হইয়া তিনি উপস্থিত হইয়াছিলেন, এবং তাহার স্বামীর সহিতও পরিচয় ঘটিবার তাঁহার সুযোগ হইয়াছিল। এইরূপে নানা আত্মীয়তা-সূত্রে আপনার জন বলিয়াই বেলা আগ্রায় আসিয়া উঠিয়াছিল। নিতান্ত পরের মতও আসে নাই, নিরাশ্রয় হইয়াও বাড়িতে ঢুকে নাই। এ তুলনায় নীলিমার সহিত তাহার যথেষ্ট প্রভেদ।
অথচ, অবস্থাটা দাঁড়াইয়াছিল একেবারে অন্যরূপ। এ গৃহে কাহার স্থান যে কোথায়, এ বিষয়ে বাটীর কাহারও মনে তিলার্ধ সন্দেহ ছিল না। কিন্তু হেতুও ছিল যেমন অজ্ঞাত, কর্তৃত্বও ছিল অবিসম্বাদিত।
বহুক্ষণ মৌন থাকার পরে বেলাই প্রথমে কথা কহিল। বলিল, স্পষ্ট নয় মানি, কিন্তু আমাকে ধিক্কার দেবার জন্যেই যে ও-কথা নীলিমা বলেছেন, এ বিষয়ে আমার সন্দেহ নেই।
আশুবাবুর মনের মধ্যেও হয়ত সন্দেহ ছিল না, তথাপি বিস্ময়ের কণ্ঠে জিজ্ঞাসা করিলেন, ধিক্কার? ধিক্কার কিসের জন্যে বেলা?
বেলা কহিল, আপনি ত সমস্তই জানেন। নিন্দে করবার লোকের সেদিনও অভাব হয়নি, আজও হবে না। কিন্তু নিজের সম্মান, সমস্ত নারী-জাতির সম্মান রাখতে সেদিনও গ্রাহ্য করিনি, আজও করব না। নিজের মর্যাদা খুইয়ে স্বামীর ঘর করতে চাইনি বলে সেদিন গ্লানি প্রচার করেছিল মেয়েরাই সবচেয়ে বেশি, আজও তাদেরই হাত থেকে আমার নিস্তার পাওয়া সবচেয়ে কঠিন। কিন্তু অন্যায় করিনি বলে সেদিনও যেমন ভয় পাইনি, আজও আমি তেমনি নির্ভয়। নিজের বিবেকবুদ্ধির কাছে আমি সম্পূর্ণ খাঁটী।
নীলিমা সেলাই হইতে মুখ তুলিল না, কিন্তু আস্তে আস্তে কহিল, একদিন কমল বলছিলেন যে, বিবেকবুদ্ধিটাই সংসারের মস্তবড় বস্তু নয়। বিবেকের দোহাই দিয়েই সমস্ত ন্যায়-অন্যায়ের মীমাংসা হয় না।
আশুবাবু আশ্চর্য হইয়া কহিলেন, সে বলে নাকি?
নীলিমা কহিল, হ্যাঁ। বলেন, ওটা শুধু নির্বোধের হাতের অস্ত্র। সামনে-পিছনে দুদিকেই কাটে—ওর কোন ঠিক-ঠিকানা নেই।
উপন্যাস : শেষ প্রশ্ন Chapter : 22 Page: 155
- Details
- Sarat Chandra Chattopadhyay ।। শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
- শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
- Category: শেষ প্রশ্ন
- Read Time: 1 min
- Hits: 166