কমল নিঃশব্দে চাহিয়া রহিল। অজিত ধীরে ধীরে বলিতে লাগিল, কমল, একটা গল্প বলি শোনো। আমার মাকে একবার আমাদের গৃহদেবতা রাধাবল্লভজীউ পূজোর ঘরে মূর্তি ধরে দেখা দিয়েছিলেন, তাঁর হাত থেকে খাবার নিয়ে সুমুখে বসে খেয়েছিলেন,—এ তাঁর নিজের চোখে দেখা। তবুও বাড়ির কেউ আমরা বিশ্বাস করতে পারিনি। সবাই বুঝলে এ তাঁর স্বপ্ন, কিন্তু এই অবিশ্বাসের দুঃখ তাঁর মৃত্যুকাল পর্যন্ত যায়নি। আজ তোমার কথা শুনে আমার সেই কথা মনে পড়চে। তুমি তামাশা করোনি জানি, কিন্তু আমার মায়ের মতো তোমারো কোথাও মস্ত ভুল হয়েছে। মানুষের জীবনে এমন বহুকাল যায় নিজের সম্বন্ধে সে অন্ধকারেই থাকে। হয়ত হঠাৎ একদিন চোখ খোলে। আমারও তেমনি। এতদিন পৃথিবীর কত জায়গাতেই ত ঘুরেচি, শুধু এই আগ্রায় এসে আমি নিজেকে দেখতে পেলাম। আমার থাকার মধ্যে আছে শুধু টাকা, বাবার দেওয়া। এ ছাড়া এমন কিছুই নিজের নেই যে আমারও অজ্ঞাতসারে তুমি আমাকেই ভালবাসতে পার।
কমল কহিল, টাকার জন্যে ভাবনা নেই, আশ্রমবাসীরা একবার যখন সন্ধান পেয়েছে তখন সে ব্যবস্থা তারাই করবে, এই বলিয়া সে হাসিয়া কহিল, কিন্তু অন্য সকল দিকেই যে আপনি এমন নিঃস্ব এ খবর কি ছাই আগে পেয়েছি? তা ছাড়া, ভাল-মন্দ বুঝে দেখবার সময় পেলাম কৈ? মনের মধ্যে শুধু একটা সন্দেহের মতই ছিল,—ঠিকানা পেতাম না,—কেবল এই ত মিনিট-দশেক হ’লো একলা ঘরে বিছানার সুমুখে দাঁড়িয়ে অকস্মাৎ ঠিক খবরটি কে এসে আমার কানে কানে দিয়ে গেল।
অজিত গভীর বিস্ময়ে প্রশ্ন করিল, সত্যি বলচো মাত্র মিনিট-দশেক? কিন্তু সত্যি হলে এ ত পাগলামি।
কমল বলিল, পাগলামিই ত! তাই ত আপনাকে বলেছিলাম, আমাকে আর কোথাও নিয়ে চলুন। বিবাহ করে ঘর-সংসার করুন, এ ভিক্ষে ত চাইনি?
অজিত অত্যন্ত কুণ্ঠিত হইল, কহিল, ভিক্ষে বলচ কেন কমল, এ ভিক্ষে চাওয়া নয়, এ তোমার ভালবাসার অধিকার। কিন্তু অধিকারের দাবী তুমি করলে না, চাইলে শুধু তাই যা বুদবুদের মত স্বল্পায়ু এবং তারই মত মিথ্যে।
কমল কহিল, হতেও পারে এর পরমায়ু কম, কিন্তু তাই বলে মিথ্যে হবে কেন? আয়ুর দীর্ঘতাকেই যারা সত্য বলে আঁকড়ে ধরতে চায়, আমি তাদের কেউ নয়।
কিন্তু এ আনন্দের যে কোন স্থায়িত্ব নেই কমল!
না-ই থাক। কিন্তু গাছের ফুল শুকোবে বলে সুদীর্ঘস্থায়ী শোলার ফুলের তোড়া বেঁধে যারা ফুলদানিতে সাজিয়ে রাখে, তাদের সঙ্গে আমার মতে মেলে না। আপনাকে আরও একবার ঠিক এই কথাই বলেছিলাম যে, কোন আনন্দেরই স্থায়িত্ব নেই। আছে শুধু তার ক্ষণস্থায়ী দিনগুলি। সেই ত মানব-জীবনের চরম সঞ্চয়। তাকে বাঁধতে গেলেই সে মরে। তাই ত বিবাহের স্থায়িত্ব আছে, নেই তার আনন্দ। দুঃসহ স্থায়িত্বের মোটা দড়ি গলায় বেঁধে সে আত্মহত্যা করে মরে।
উপন্যাস : শেষ প্রশ্ন Chapter : 21 Page: 148
- Details
- Sarat Chandra Chattopadhyay ।। শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
- শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
- Category: শেষ প্রশ্ন
- Read Time: 1 min
- Hits: 156