কমল বিস্ময়ে চাহিয়া রহিল। তাঁহার বাক্যের তাৎপর্য যে নিঃসংশয়ে বুঝিতেছে তাহা নয়,—যেন কুয়াশার মধ্যে আগন্তুকের মুখ দেখা। কিন্তু পায়ের চলন অত্যন্ত চেনা।
আশুবাবু আপনিই থামিলেন। বোধ হয় কমলের বিস্মিত দৃষ্টি তাঁহাকে নিজের দিকে সচেতন করিল, বলিলেন, তোমার সঙ্গে আমার আরও অনেক কথা আছে কমল, আর একদিন এসো।
আসবো। আজ যাই।
এসো। গাড়িটা নীচেই আছে, তোমাকে পৌঁছে দেবে বলেই বাসদেওকে এখনো ছুটি দিইনি। অজিত, তুমিও কেন সঙ্গে যাও না, ফেরবার পথে তোমাদের আশ্রমে তোমাকে নামিয়ে দিয়ে আসবে!
উভয়ে তাঁহাকে নমস্কার করিয়া বাহির হইয়া আসিল। বেলা সঙ্গে সঙ্গে গাড়ির কাছে আসিয়া কহিল, আপনার সঙ্গে আলাপ করবার আজ সময় হলো না, কিন্তু এবার যেদিন দেখা হবে আমি ছাড়বো না।
কমল হাসিয়া ঘাড় নাড়িয়া কহিল, সে আমার সৌভাগ্য। কিন্তু ভয় হয় পরিচয় পেয়ে না আপনার মত বদলায়।
গাড়ির মধ্যে দুজনে পাশাপাশি বসিয়া। রাস্তায় মোড় ফিরিলে কমল কহিল, সেদিনের রাতটাও এমনি অন্ধকার ছিল, মনে পড়ে?
পড়ে।
সেদিনের পাগলামি?
তাও মনে পড়ে।
আমি রাজী হয়েছিলাম সে মনে আছে?
অজিত হাসিয়া কহিল, না। কিন্তু আপনি যে বিদ্রূপ করেছিলেন সে মনে আছে।
কমল বিস্ময় প্রকাশ করিয়া কহিল, বিদ্রূপ করেছিলাম? কৈ না!
নিশ্চয় করেছিলেন।
কমল বলিল, তা হলে আপনি ভুল বুঝেছিলেন। সে যাক, আজ ত আর তা করচি নে—চলুন না, আজই দুজনে চলে যাই?
দ্যুৎ! আপনি ভারী দুষ্টু।
কমল হাসিয়া ফেলিল, কহিল, দুষ্টু কিসের? আমার মত এমন শান্ত সুবোধ কে আছে বলুন ত? হঠাৎ হুকুম করলেন, কমল, চল যাই,—তক্ষুনি রাজী হয়ে বললাম, চলুন।
কিন্তু সে ত শুধু পরিহাস।
কমল বলিল, বেশ, না হয় পরিহাসই হলো, কিন্তু হঠাৎ অপরাধটা কি করেছি বলুন ত? ডাকতেন তুমি বলে, আরম্ভ করেছেন আপনি বলতে। কত দুঃখে-কষ্টে দিন চলে—আপনাদেরই জামা-কাপড় সেলাই করে কোন মতে হয়ত দুটি খেতে পাই, অথচ আপনার টাকার অবধি নেই,—একটা দিনও কি খবর নিয়েছেন? মনোরমা এ দুঃখে পড়লে কি আপনি সইতেন? দিনরাত খেটে খেটে কত রোগা হয়ে গেছি দেখুন ত? এই বলিয়া সে নিজের বাঁ হাতখানি অজিতের হাতের উপর রাখিতেই আচম্বিতে তাহার সর্বশরীর শিহরিয়া উঠিল। অস্ফুটে কি একটা বলিতে চাহিল, কিন্তু সহসা হাত টানিয়া লইয়া চেঁচাইয়া উঠিল, ড্রাইভার, রোকো রোকো,— এ যে পাগলা-গারদের সামনে এসে পড়েচি। গাড়ি ঘুরিয়ে নাও। অন্ধকারে ঠিক ঠাওর করতে পারা যায়নি।
অজিত কহিল, হাঁ, দোষ অন্ধকারের। শুধু সান্ত্বনা এই যে, হাজার অবিচারেও ও-বেচারার প্রতিবাদ করবার জো নেই। সে অধিকারে ও বঞ্চিত। এই বলিয়া সে একটু হাসিল। শুনিয়া কমলও হাসিল, কহিল, তা বটে। কিন্তু বিচার জিনিসটাই ত সংসারে সব নয়; এখানে অবিচারেরও স্থান আছে বলে আজও দুনিয়া চলচে, নইলে কোন্কালে সে থেমে যেতো। ড্রাইভার, থামাও।
উপন্যাস : শেষ প্রশ্ন Chapter : 21 Page: 142
- Details
- Sarat Chandra Chattopadhyay ।। শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
- শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
- Category: শেষ প্রশ্ন
- Read Time: 1 min
- Hits: 177