হরেন কি যে জবাব দিবে খুঁজিয়া পাইল না। লজ্জায় সে এমনি জড়সড় হইয়া উঠিল যে, এই মিষ্ট কথাগুলি যিনি অবলীলাক্রমে বলিয়া গেলেন তাঁহার মুখের দিকেও চাহিতে পারিল না। কিন্তু লজ্জা কাটিতেও তাহার দিন-দুয়ের বেশী লাগিল না। ঠিক যেন না কাটিয়া উপায় নাই,—এমনি। এই রমণীর যেমন স্বচ্ছন্দ অনাড়ম্বর প্রীতি, তেমনি সহজ সেবা। তিনি যে বিধবা, সংসারে তাঁহার যে সত্যকার আশ্রয় কোথাও নাই—তিনিও যে এ বাড়িতে পর—এই কথাটাও একদিকে যেমন তাঁহার মুখের চেহারায়, তাঁহার সাজসজ্জায়, তাঁহার রহস্য-মধুর আলাপ-আলোচনায় ধরিবার জো নেই, তেমনি এইগুলাই যে তাঁহার সবটুকু নহে এ কথাটাও না বুঝিয়া উপায়ান্তর নাই।

বয়স নিতান্ত কম নহে, বোধ করি বা ত্রিশের কাছাকাছি গিয়া পৌঁছিয়াছে। এই বয়সের সমুচিত গাম্ভীর্য হঠাৎ খুঁজিয়া পাওয়া দায়,—এমনি হালকা তাঁহার হাসি-খুশির মেলা, অথচ একটুখানি মনোনিবেশ করিলেই স্পষ্ট বুঝা যায়—এমন একটা অদৃশ্য আবেষ্টন তাঁহাকে অহর্নিশি ঘিরিয়া আছে যাহার ভিতরে প্রবেশের পথ নাই। বাটীর দাসী-চাকরেরও না, বাটীর মনিবেরও না।

এই গৃহে, এই আবহাওয়ার মাঝখানেই হরেন্দ্রর সপ্তাহ-দুই কাটিয়া গেল। হঠাৎ একদিন সে আলাদা বাসা ভাড়া করিয়াছে শুনিয়া নীলিমা ক্ষুণ্ণ হইয়া কহিল, এত তাড়াতাড়ি করতে গেলে কেন ঠাকুরপো, এখানে কি এমন তোমার আটকাচ্ছিল?

হরেন্দ্র সলজ্জে কহিল, একদিন ত যেতেই হত বৌদি।

নীলিমা জবাব দিল, তা হয়ত হত। কিন্তু দেশসেবার নেশার ঘোর তোমার এখনো চোখ থেকে কাটেনি ঠাকুরপো, আরও দিন-কতক না হয় বৌদির হেপাজতেই থাকতে।

হরেন্দ্র বলিল, তাই থাকব বৌদি। এই ত মিনিট-দশেকের পথ—আপনার দৃষ্টি এড়িয়ে যাব কোথায়?

অবিনাশ ঘরের মধ্যে বসিয়া কাজ করিতেছিলেন; সেইখান হইতেই কহিলেন, যাবে জাহান্নমে। অনেক বারণ করেছিলাম, হরেন, যাসনে আর কোথাও, এইখানে থাক। কিন্তু সে কি হয়? ইজ্জত বড়—না দাদার কথা বড়! যাও, নতুন আড্ডায় গিয়ে দরিদ্র-নারায়ণের সেবা চড়াও গে। ছোটগিন্নী, ওকে বলা বৃথা। ও হল চড়কের সন্ন্যাসী—পিট ফুঁড়ে ঘুরতে না পেলে ওদের বাঁচাই মিথ্যে।

নূতন বাসায় আসিয়া হরেন্দ্র চাকর-বামুন রাখিয়া অতিশয় শান্তশিষ্ট নিরীহ মাস্টারের ন্যায় কলেজের কাজে মন দিল। প্রকাণ্ড বাড়িতে অনেক ঘর। গোটা-দুই ঘর ছাড়া বাকী সমস্তই পড়িয়া রহিল। মাস-খানেক পরেই এই শূন্য ঘরগুলা তাহাকে পীড়া দিতে লাগিল। ভাড়া দিতে হয়, অথচ কাজে লাগে না।অতএব পত্র গেল রাজেনের কাছে। সে ছিল তাহার দুর্ভিক্ষ-নিবারণী-সমিতির সেক্রেটারি। দেশোদ্ধারের আগ্রহাতিশয্যে বছর-দুই অন্তরীণ থাকিয়া মাস পাঁচ-ছয় ছাড়া পাইয়া সাবেক বন্ধুবান্ধবগণের সন্ধানে ফিরিতেছিল।

Sarat Chandra Chattopadhyay ।। শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়