দক্ষিণের বারান্দায় দেয়াল ঘেঁষিয়া ছয়-সাতটা বড় বড় মাটির কলসী বিড়ার উপর বসান আছে। হয়ত গুড় আছে, কি কি আছে জানি না, কিন্তু যত্ন দেখিয়া মনে হইল না যে, তাহারা শূন্যগর্ভ কিংবা অবহেলার বস্তু। কয়েকটা খুঁটির গায়েই দেখিলাম ঢেরা- সমেত পাট এবং শনের গোছা বাঁধা রহিয়াছে; সুতরাং বাটিতে যে বিস্তর দড়িদড়ার আবশ্যক হয় তাহা অনুমান করা অসঙ্গত জ্ঞান করিলাম না।
কুশারীগৃহিণী খুব সম্ভব আমাদের অভ্যর্থনার কাজেই অন্যত্র নিযুক্তা, কর্তাটিও একবারমাত্র দেখা দিয়াই অন্তর্ধান করিয়াছিলেন; তিনি অকস্মাৎ ব্যস্তসমস্ত হইয়া উপস্থিত হইলেন এবং রাজলক্ষ্মীকে উদ্দেশ করিয়া অনুপস্থিতির কৈফিয়ত আর একপ্রকারে দিয়া কহিলেন, মা, এইবার যাই, আহ্নিকটা সেরে এসে একেবারে বসি। বছর পনর-ষোলর একটি সুন্দর সবলকায় ছেলে উঠানের একধারে দাঁড়াইয়া গভীর মনোযোগের সহিত আমাদের কথাবার্তা শুনিতেছিলেন, কুশারীমহাশয়ের দৃষ্টি তাহার প্রতি পড়িতেই বলিয়া উঠিলেন, বাবা হরিপদ, নারায়ণের অন্ন বোধ করি এতক্ষণে প্রস্তুত হল, একবার ভোগটি দিয়ে এসো গে বাবা। আহ্নিকের বাকিটুকু শেষ করতে আর আমার দেরি হবে না। আমার প্রতি চাহিয়া কহিলেন, আজ মিছাই আপনাকে কষ্ট দিলাম—বড় দেরি হয়ে গেল। এই বলিয়া আমার প্রত্যুত্তরের অপেক্ষায় আর দেরি না করিয়া চক্ষের পলকে নিজেই অদৃশ্য হইয়া গেলেন।
এইবার যথাকালে, অর্থাৎ যথাকালের অনেক পরে আমাদের মধ্যাহ্ন-ভোজনের ঠাঁই করার খবর পৌঁছিল। বাঁচা গেল। কেবল অতিরিক্ত বেলার জন্যে নয়, এইবার আগন্তুকগনের প্রশ্নবাণে বিরতি অনুভব করিয়াই হাঁফ ছাড়িয়া বাঁচিলাম। তাঁহারা আহার্য প্রস্তুত হইয়াছে শুনিয়া অন্ততঃ কিছুক্ষণের জন্য আমাকে অব্যাহতি দিয়া যে যাঁহার বাড়ি চলিয়া গেলেন। কিন্তু খাইতে বসিলাম কেবল আমি একা। কুশারীমহাশয় সঙ্গে বসিলেন না, কিন্তু সম্মুখে আসিয়া বসিলেন। হেতুটা তিনি সবিনয়ে এবং সগৌরবে নিজেই ব্যক্ত করিলেন। উপবীত-ধারণের দিন হইতে ভোজনকালে সেই যে মৌনী হইয়াছিলেন, সে ব্রত আজও ভঙ্গ করেন নাই; সুতরাং একাকী নির্জন গৃহে এই কাজটা তিনি এখনও সম্পন্ন করেন। আপত্তি করিলাম না, আশ্চর্য হইলাম না। কিন্তু রাজলক্ষ্মী সম্বন্ধে যখন শুনিলাম, আজ তাহারও নাকি কি একটা ব্রত আছে—পরান্ন গ্রহণ করিবে না, তখনই আশ্চর্য হইলাম। এই ছলনায় মনে মনে ক্ষুব্ধ হইয়া উঠিলাম এবং ইহার কি যে প্রয়োজন ছিল তাহা ভাবিয়া পাইলাম না। কিন্তু রাজলক্ষ্মী আমার মনের কথা চক্ষের পলকে বুঝিয়া লইয়া কহিল, তার জন্যে তুমি দুঃখ কোরো না, ভাল করে খাও। আমি যে আজ খাব না, এঁরা সবাই জানতেন।
বলিলাম, অথচ আমি জানতাম না। কিন্তু এই যদি, কষ্ট স্বীকার করে আসার কি আবশ্যক ছিল?
ইহার উত্তর রাজলক্ষ্মী দিল না, দিলেন কুশারীগৃহিণী। কহিলেন, এ কষ্ট আমিই স্বীকার করিয়েচি বাবা। মা যে এখানে খাবেন না তা জানতাম; তবু আমরা যাঁদের দয়ায় দুটি অন্ন পাই, তাঁদের পায়ের ধুলো বাড়িতে পড়বে এ লোভ সামলাতে পারলাম না। কি বল মা? এই বলিয়া তিনি রাজলক্ষ্মীর মুখের প্রতি চাহিলেন।
রাজলক্ষ্মী বলিল, এর জবাব আজ নয় মা, আর একদিন আপনাকে দেব। এই বলিয়া সে হাসিল।
উপন্যাস : শ্রীকান্ত (তৃতীয় পর্ব) Chapter : 6 Page: 39
- Details
- Sarat Chandra Chattopadhyay ।। শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
- শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
- Category: শ্রীকান্ত (তৃতীয় পর্ব)
- Read Time: 1 min
- Hits: 208