আমি গেলাসের জলে হাতখানা একবার ডুবাইয়া লইয়া জিজ্ঞাসা করিলাম, এখন তাঁদের কি করে চলে?

কুশারীগৃহিণী কাতর হইয়া বলিলেন, এর জবাব আর আমাকে দিতে ব’লো না বাবা। এ আলোচনা কেউ করতে এলে আমি কানে আঙ্গুল দিয়ে ছুটে পালিয়ে যাই,—মনে হয় বুঝিবা আমার দম বন্ধ হয়ে যাবে। এই আট মাস এ-বাড়িতে মাছ আসে না, দুধ-ঘির কড়া চড়ে না। সমস্ত বাড়িটার ওপর কে যেন এক মর্মান্তিক অভিশাপ রেখে চলে গেছে। এই বলিয়া তিনি চুপ করিলেন, এবং বহুক্ষণ ধরিয়া তিনজনেই আমরা স্তব্ধ হইয়া নিঃশব্দে বসিয়া রহিলাম।

ঘণ্টাখানেক পরে আমরা আবার যখন গাড়িতে গিয়া বসিলাম, কুশারীগৃহিণী সজলকণ্ঠে রাজলক্ষ্মীর কানে কানে বলিলেন, মা, তারা তোমারই প্রজা। আমার শ্বশুরের দরুন যে জমিটুকুর ওপর তাদের নির্ভর সেটুকু তোমার গঙ্গামাটিতেই।

রাজলক্ষ্মী ঘাড় নাড়িয়া কহিল, আচ্ছা।

গাড়ি ছাড়িয়া দিতে তিনি পুনশ্চ বলিয়া উঠিলেন, মা, তোমার বাড়ি থেকেই চোখে পড়ে। নালার এ-দিকে যে ভাঙা পোড়ো ঘরটা দেখা যায়, সেইটে।

রাজলক্ষ্মী তেমনি নাথা নাড়িয়া জানাইল, আচ্ছা।

গাড়ি মন্থরগতিতে অগ্রসর হইল। অনেকক্ষণ পর্যন্ত আমি কোন কথাই কহিলাম না। চাহিয়া দেখিলাম, রাজলক্ষ্মী অন্যমনস্ক হইয়া কি ভাবিতেছে। তাহার ধ্যান ভঙ্গ করিয়া কহিলাম, লক্ষ্মী, যার লোভ নেই, যে চায় না, তাকে সাহায্য করতে যাওয়ার মত বিড়ম্বনা আর নেই।

রাজলক্ষ্মী আমার মুখের প্রতি চাহিয়া অল্প একটুখানি হাসিয়া বলিল, সে আমি জানি। তোমার কাছে আমার আর কিছুই না হোক এ শিক্ষা হয়েচে!

Sarat Chandra Chattopadhyay ।। শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়