সকাল ন’টা।

এ সময় সাধাবণত সবাইকে ঘরে পাওয়া যায।

মিলি বাসায় ছিল না। মিলির বর মতিয়ুর রহমান ছিল। এই ছেলেটিকে ওসমান সাহেব পছন্দ কলেন। অথচ সে ঠিক পছন্দ করার মত মানুষ নয়। উদ্ধত প্রকৃতির মানুষ! হিসেবী ও বৈষয়িক। তবু তাকে ভাল লাগে। কেন? চেহারার জন্যে নিশ্চযই নয়। মতিয়ুর রহমানের চেহারা ভাল নয়। গ্রাম্যভাব আছে। ওসমান সাহেবকে দেখে মতিয়ুর রহমান খুবই অবাক হল। অতিরিক্ত বকমের ব্যস্ত হয়ে পড়ল।

ভাই সাহেব কেমন আছেন?

ভাল।

হঠাৎ এদিকে?

এমনি এলাম। তেমন কারণ নেই। মিলি কোথায?

মিলি ডাক্তারেব কাছে গেছে। এখনি চলে আসবে।

ঠিক আছে, আমি বসছি। মিলির সঙ্গে দেখা হয় না। অনেক দিন। ও আছে কেমন?

ভালই আছে। অবশ্যি সব সময কমপ্লেইন করে ঘুম হয় না। আমি কিন্তু দেখি ঠিকই ঘুমাচ্ছে।

ওষুধ খেয়ে ঘুমায়?

না। এমনিতেই ঘুমায।

একজন সাইকিযাটিস্ট দেখালে কেমন হয?

সাইকিয়াট্রিস্ট?

হ্যাঁ। ও বোধ হয় ঠিক সুস্থ না।

মতিয়ুর অনেক্ষণ চুপ করে থেকে অপ্রাসঙ্গিকভাবেই বলল,

ভাই সাহেব, আপনি কী আজ দুপুরে আমাদের সঙ্গে চারটা ডাল-ভাত খাবেন।

খাব। আমি বিকেল পর্যন্ত থাকব। এখানে। মিলি আসবে কখন?

আমি ওকে আনার জন্যে লোক পাঠাচ্ছি।

লোক পাঠানোর দরকার নেই। ও আসুক। ধীরে-সুস্থে।

ডাক্তারের কাছে অন্য সমযও যেতে পারবে। এখন এসে আপনার জন্য নিজের হাতে বান্নাবান্না করুক। খুব খুশি হবে। আপনি কি হাত-মুখ ধোবেন?

না। তুমি তোমার কাজ কর। আমার জন্যে ব্যস্ত হতে হবে না। একা বসে থাকতে আমার খারাপ লাগে না। ভালই লাগে।

আপনি চা খান, আমি আধ-ঘণ্টার মধ্যে আসছি।

বাজারে যাচ্ছে নাকি?

না মিলিকে নিয়ে আসতে যাচ্ছি।

তিনি এদের এই বাড়িতে অনেক দিন পর এসেছেন। বাড়ির অনেক রকম পরিবর্তন হয়েছে। নতুন ঘর উঠেছে কয়েকটি। মিলিদের এই বাড়ি কিনে নেবার কথা ছিল, কিনে নিয়েছে কিনা কে জানে। সওদাগরদের বাড়ির মত বিশাল এক বাড়ি। আসবাবপত্র ঠাসা। এদের প্রচুর পয়সা হয়েছে মনে হয়। আগে এত সচ্ছলতা ছিল না।

মিলি বাড়িতে ঢুকেই উচ্ছসিত হয়ে উঠল। কল কল করে বলল,

তুমি আমার এখানে আসবে এটা আগে বললে না কেন?

আগে বললে কি হত?

কত কিছু করতাম।

তোর মেয়ের নাম ঠিক করেছিস?

হ্যাঁ মিনতি। নামটা কেমন ভাইয়া?

সুন্দর নাম। আমি আসতে আসতে তোর মেয়ের জন্যে নাম ভাবছিলাম। তিন অক্ষরের ম দিয়ে শুরু।

কি নাম?

ময়ূর।

মিলি অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল। যেন নিজের কানকেই বিশ্বাস করতে পারছে না।

ময়ুর?

হ্যাঁ।

ময়ূর কখনো নাম হয়? তোমার কি মাথা-টাথা খারাপ হয়েছে না কি ভাইয়া?

বোধ হয় হচ্ছে।

মিলি খুব হাসতে লাগল। যেন অনেক দিন পর সে মজার একটা কথা শুনল। হাসির ভঙ্গিও অস্বাভাবিক। ওসমান সাহেব মনে মনে ভাবলেন। মিলি কি সত্যি অসুস্থ? মতিয়ুর রাগী চোখে তাকিয়ে আছে। হাসি থামলেই সে হয়ত কিছু বলবে। মিলি হাসি থামাল। তার চোখে পানি এসে গিয়েছিল। আঁচল দিয়ে চোখ মুছল। মতিয়ুর বলল, তুমি যাও রান্না-বান্না শুরু কর। বারটা বাজে।

আমার রাঁধতে ইচ্ছা হচ্ছে না। অন্য কেউ রাঁধুক।

তুমি কি করবে?

আমি ভাইয়ার সঙ্গে গল্প করব। তুমি কাউকে বল। কিংবা হোটেল থেকে কিছু আনিয়ে নাও।

মতিয়ুর চলে গেল। তার মুখ থম থম করছে। ঘরে রান্না-বান্না করার কেউ হয়ত নেই। খুব সহজেই মিলি হোটেলের প্রসঙ্গ এনেছে তার মানে এরা প্রায়ই হোটেল থেকে খাবার অ্যানিয়ে নেয়। কিন্তু ওর শাশুড়ি তো এখানে থাকেন। তিনি থাকতে হোটেলের খাবার আসর্বে এ বাড়িতে?

ভাইয়া তুমি কি মাকে কখনো স্বপ্নে দেখ।

ওসমান সাহেব ভেবে পেলেন না হঠাৎ মা-র প্রসঙ্গ কেন এল। মিলি কি এলোমেলোভাবে চিন্তা করতে শুরু করছে। তিনি মিলির দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকালেন। মিলি হালকাভাবে বলল,

আমি প্রায়ই দেখি। রোজ রাতে দেখি। কাল ও দেখেছি।

কি দেখি।

দেখি মা খুব লজ্জিত ভঙ্গিতে আমার কাছে এসে দাঁড়ান। অস্পষ্ট স্বরে বলেন, ভুল হয়ে গেছে মিলি, কিছু মনে করিস না। তখন আমি তাঁর সঙ্গে ঝগড়া করতে শুরু করি।

কি নিয়ে ঝগড়া?

জানি না কি নিয়ে। মা এত ভাল মানুষ ছিলেন তার সঙ্গে আমি ঝগড়ার স্বপ্ন কেন দেখব?

স্বপ্ন স্বপ্নাই।

না, স্বপ্ন স্বপ্ন না। স্বপ্নের অনেক মানে আছে।

মিলি কাঁদতে শুরু করল। তিনি কি বলবেন ভেবে পেলেন না।

কান্না থামা মিলি।

মিলি সঙ্গে সঙ্গে কান্না থামাল। ওসমান সাহেব বললেন, আমি কিছু দিন আমাদের গ্রামের বাডিতে গিয়ে থাকব।

কেন?

এমনি।

কোনো বিশেষ কারণ নেই।

আমি ও তোমার সঙ্গে যাব ভাইয়া।

একা থাকার জন্যে যাচ্ছি। দলবল এসে গেলে তো আর থাকা যাবে না।

এখানে তো একাই থাকতে।

তা ঠিক।

গ্রাম এবং শহর বেশ কমটা কি হচ্ছে?

ওসমান সাহেব মৃদু স্বরে বললেন, অনেক দিন থেকে কিছু লিখতে পারছি না। পরিবেশ বদলে দেখতে চাই লাভ হয় কি না।

তোমার রান্না-বান্না করে দেবে কে?

লোকজন পাওয়া যাবে নিশ্চয়ই।

যাবে কবে?

কাল।

রানু ভাবী জানে?

না।

মিলি খানিক্ষণ ইতস্তত করে বলল, গতকাল রানু ভাবী আর আলম ছেলেটিকে দেখলাম রিকশা করে যাচ্ছে। হাত ধরাধরি করে দু’জন বসে আছে। ওসমান সাহেব হেসে ফেললেন। মিলি বিরক্তি স্বরে বলল, হাসছ কেন?

এমনি হাসছি।

মিলির কোনো ভাবান্তর হল না। ওসমান সাহেব বললেন, কাউকে দিয়ে সিগারেট আনিয়ে দে। সিগারেট শেষ হয়ে গেছে। মিলি উঠল না। যেভাবে বসেছিল। সেভাবেই বসে রইল। যেন তার কথা শুনতে পায়নি।

মিলি।

বল।

মতিয়ুরের সঙ্গে কথা বলছিলাম। সে তোকে একজন ডাক্তারের কাছে নিয়ে যেতে চায়।

জানি, পাগলের ডাক্তার। তোমার কী মনে হয় আমি পাগল?

না, পাগল হবি কেন?

আমাকে সান্ত্বনা দেবার জন্যে বলছি আসলে তোমার নিজেরও ধারণা আমি পাগল। তা না হলে ডাক্তারের কথা তুলতে না।

তুই এত সুন্দর লজিক বের করেছিস। এরপর তোকে পাগল বলবে কে?

বলে, সবাই বলে। আমার শাশুড়ি এখন আমাকে দেখে এমন ভয় পান, আমি ঘরে ঢুকলেই চমকে ওঠেন। পাগলকে মানুষ যেমন ভয় পায় সে রকম আর কি!

বলতে বলতে মিলি খিলখিল করে হাসতে শুরু করল। সে হাসি আর কিছুতেই থামে না। ওসমান সাহেব অবাক হয়ে মিলির দিকে তাকিয়ে রইলেন। সম্পূর্ণ অপ্রকৃতস্থ একজন মানুষের হাসি। মতিয়ুর ঘরে ঢুকে ধমক দিল, আবার কি শুরু করেছ? মিলির হাসি থেমে গেল। সে থমথমে গলায় বলল, আমি হাসতেও পারব না?

তুমি রান্না ঘরে যাও তো মিলি।

না, আমি রান্না ঘরে যাব না। এখানেই থাকব। এবং ভাইয়াকে সব কথা বলে দেব আমি। ভাইয়া শোন ও এখন আমাকে ঘর থেকে বেরুতে দেয় না। গোটে তালা দিয়ে রাখে। কাউকে টেলিফোনও করতে দেয় না। টেলিফোনের মাউথ পিস খুলে রেখেছে। সে যখন কাউকে টেলিফোন করতে চায় তখন মাউথ পিস লাগায়।

মিলি তুমি রান্না ঘরে যাও তো।

না, আমি যাব না। কি করবে তুমি? মারবে আমাকে? বেশ তো মার।

ওসমান সাহেব মৃদু স্বরে বললেন, ক্ষিধে লেগেছে মিলি, খাওয়ার ব্যবস্থা কর। মিলি শান্ত মেয়ের মত সঙ্গে সঙ্গে উঠে দাঁড়াল। হাসি মুখে বলল, দশ মিনিটের মধ্যে খাবার দেব। সে ছুটে বেরিয়ে গেল। ওসমান সাহেব মাথা নিচু করে চুপচাপ বসে রইলেন, আর সামনে মতিয়ুর রহমান বসে আছেন। দুজনের কারুর মুখেই কোন কথা নেই।

মিলিদের বাড়ি থেকে তিনি বের হলেন সন্ধ্যার পর। রিকশাওয়ালাকে বললেন, আমি কোথাও যাব না। শহরেই খানিকটা ঘুরব। তোমার যে দিকে যেতে ইচ্ছা করে সেদিকে যাও।

রিকশাওয়ালা ইতস্তত করছে। মন ঠিক নেই এমন কাউকে রিকশায় তুলতে তার হয়ত দ্বিধা আছে।

<

Humayun Ahmed ।। হুমায়ূন আহমেদ