দিন কয়েক মাথার সত্যিই ঠিক ছিল না রেমির। তার সামান্য মাথা কতই বা বইতে পারে? কিন্তু সেই কয়েকটা দিন ধ্রুব ছিল অস্বাভাবিক রকমের স্বাভাবিক। এক ফোঁটা মদ খায়নি। অফিসে যায়নি। বলতে গেলে সারাক্ষণই বাড়িতে থেকেছে। পিছন দিকে সামান্য একটু জমি আছে। সেখানে কোনওকালে ফুলগাছ লাগানো হত। আজকাল হয় না। ধ্রুব হঠাৎ সেই পতিত জমি উদ্ধারে মন দিল কয়েকদিন। মাটি খুঁড়ে সার দিয়ে কয়েকটা গাছ লাগাল।

আর রেমি তখন ঘরবন্দি হয়ে কখনও হাসে, কখনও কাঁদে, কখনও চুপ করে বসে থাকে। কী ভাবে, তা সে নিজেও ভাল বুঝতে পারে না। কোনও বিষয়ে আগাগোড়া কিছুই চিন্তা করতে পারে না সে। কখনও এটা নিয়ে এক টুকরো ভাবে, কখনও আর-একটা নিয়ে আর-এক টুকরো ভাবে। মাথার ভিতর দিয়ে খণ্ড-মেঘের মতো চিন্তা ভেসে যায়। কোনওটাই থামে না, আকাশ ভরে ওঠে না, ঘটে না। বৃষ্টিপাত। ধ্রুবর প্রেমিকার কথা ভাবে একটু, তক্ষুনি রাজার মুখ মনে পড়ে যায়, কৃষ্ণকান্তর জন্য ভাবনা হতে থাকে হঠাৎ, তারপর না-হওয়া একটা বাচ্চার অশ্রুত কান্নার শব্দ কানে আসে তার। সমীর! হ্যাঁ, সমীরকেও তার মনে পড়ে। জলঢাকা যাওয়ার পথে সমীরের সেই তার কাছে আত্মবিসর্জন! সবচেয়ে বেশি, সবচেয়ে গভীরভাবে সে যার কথা ভাবে তার মতো শক্ত তার দ্বিতীয় নেই। ধ্রুব।

ধ্রুব তাকে লক্ষ করে, কিন্তু বেশি কথা বলে না। একটু গম্ভীর দেখায় ওকে আজকাল। কিন্তু খুব লক্ষ করে তাকে। বিয়ের পর এতকালের মধ্যে এমন করে রেমিকে লক্ষ করেনি সে আগে।

কিন্তু ধ্রুবর সেই চোখের ভিতরে কী আছে তা টের পায় না রেমি। ভিতরে ভিতরে একটা বাঁধ কেটে যাচ্ছে তার। যে আবেগটা ধ্রুব নামে এক সীমানায় আবদ্ধ ছিল এতকাল তা আর নেই। ধ্রুবর প্রেমিকা আছে। তারও আছে রাজা। তারা তো এখন আর শুধু পরস্পরের নয়। কোথায় কী করে যেন একে অন্যের দাবি একটু করে হারিয়ে ফেলেছে।

কিন্তু রাগ করে না রেমি। অভিমানও হয় না। শুধু অসহায় এক কান্না ভিতর থেকে উঠে এসে তাকে ওলটপালট করে দিয়ে যায়।

বেসিনে মাটিমাখা হাত ধুতে ধুতে একদিন বাথরুম থেকেই ধ্রুব মুখ ফিরিয়ে তার কান্না দেখছিল। দেখতে দেখতে হঠাৎ বলল, তুমি কিন্তু একটু কেমন হয়ে যাচ্ছ। আনব্যালানসড। বুঝলে!

রেমি জবাব দিল না।

ধ্রুব এসে ভেজা হাতখানা তার কপালে রেখে বলল, এমন কিছু ঘটনা তো ঘটেনি।

ঘটেনি!—রেমি কান্নার মধ্যেও অবাক না হয়ে পারে না।

ধ্রুব উদাস গলায় বলে, আমরা তো সবাই একদিন মুছে যাব। আমরা যা সব করেছি তার চিহ্নও থাকবে না কোথাও। বুঝলে! অনুতাপ শোক এইসব কত কী করে মানুষ অযথা আয়ুর খানিকটা সময় বইয়ে দেয়। ওঠো, বি এ স্পাের্টসম্যান।

রেমি বেশ আশ্চর্য একথা শুনে উঠল। চোখের জলও মুছল। কাঁদতে কাঁদতে হিক্কা উঠে গিয়েছিল তার। সেটা বন্ধ হল না। ধ্রুবর দিকে চেয়ে বলল, তাকে আনো।

কাকে?

তাকে! আমি দেখব।

ধ্রুবর কোথাও হাসি ছিল না। চোখে না, ঠোঁটে না। রেমিকে একজন ডাক্তারের মতো চোখে দেখল কিছুক্ষণ। রোগটা ধরার চেষ্টা করল যেন। তারপর বলল, একদম পেগলে যাচ্ছ। আজকাল শ্বশুরের পদসেবা-টেবা করতেও ভুলে গেছ বোধহয়।

আমি ওঁর পদসেবা করি না তো! উনি ওরকম নন।

আহা। করলেও তো পারো।

কেন?

একটা কাজ নিয়ে থাকা ভাল। যেরকম অবস্থা করেছ তাতে এখন তোমাকে একপলক দেখেই সবাই টের পেয়ে যাবে যে, এই কচি মেয়েটার কিছু একটা হয়েছে। তোমার শ্বশুরমশাইও সেটা টের পাচ্ছেন। উনি মোর দ্যান অ্যাভারেজ বুদ্ধিমান। পদসেবা-টেবা করে সেটা কাটিয়ে দেওয়াই বুদ্ধিমতীর কাজ হবে।

রেমি একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল, ওঁকে নিয়ে তোমার কি আজকাল খুব ভাবনা হয়?

ধ্রুব একথার জবাব না দিয়ে বলল, তোমাকে নিয়েই ভাবনা হচ্ছে। কেঁদেকেটে মুখখানা করেছ রাবণের মা। এত কান্নার কী আছে? কত মেয়ে ডিভোের্স করে আবার বিয়ে করছে।

আমি কি তাদের দলে?

দল আবার কী! তারাই কি খুব খারাপ মেয়ে? যার সঙ্গে যার বনে না তার সঙ্গে খাম আর ডাকটিকিটের মতো সেঁটে থাকার দরকার কী? না বলে ছেড়ে দেওয়াই তো ভাল।

ছাড়ছিই তো।

ছাড়ছ, কিন্তু এমন একটা সিন করছ যে সবাই ভাবছে এই ছাড়ার পিছনে তোমার কোনও দায় নেই। যত দায় আমার।

রেমির চোখ ভরে জল এল ফের। সে কথা বলতে পারল না। কোনওরকমে আঁচলে চোখ ঢেকে বলল, তুমি এখন যাও। ধ্রুব চলে গেল।

রেমি তার কান্না শেষ করল অনেকক্ষণ বাদে। তারপর ভাবতে বসল। শ্বশুরমশাই কিছু টের পাচ্ছেন সত্যি? পাওয়ারই কথা। সে আজকাল দোতলার ঘরে থাকে না। থাকে ধ্রুবর সঙ্গে একই ঘরে। গত কয়েকদিন এরকমই আছে সে। কিন্তু অদ্ভুত থাকা। পাশাপাশি দুজনে শোয়, একই বিছানায়। মাঝখানে একটু নো-ম্যানস-ল্যান্ড ফাঁকা পড়ে থাকে। কেউ সেটুকু ডিঙোয় না। আসন্ন বিচ্ছেদের সূচনা? হবে। সেই বিচ্ছেদের কিছু আগাম চিহ্ন রেমির মুখ-চোখে গভীরভাবে পড়েছে। শ্বশুরমশাই তীক্ষ দৃষ্টিসম্পন্ন মানুষ। সবই লক্ষ করেন। কিন্তু কখনওই কিছু আগ বাড়িয়ে বলতে আসেন না। কৃষ্ণকান্তর স্ট্র্যাটেজি অন্যরকম। কখন দ্রুত অ্যাকশন নিতে হবে, কখন অপেক্ষা করতে হবে তিনি তা চমৎকার বোঝেন। রেমিকে তিনি বরাবর এই সুযোগটা দিয়েছেন। সম্ভবত এখনও দিচ্ছেন। রেমি আজকাল শ্বশুরের দেখাশুনো ঠিকমতো করে না। ওপরে যায় খুব কম। উনি হয়তো অপেক্ষা করেন। সব টের পেয়েও নিজে থেকে কিছু করেন না।

রেমি আজ ওপরে এল। পড়ন্ত বেলায়। কৃষ্ণকান্ত বাড়ি নেই। কখন বেরিয়েছেন তা খোঁজ নিয়ে জেনে রেমি বুঝতে পারল, উনি দুপুরে খাননি। আজকাল নাকি প্রায়দিনই দুপুরে খান না। পার্টির কী সব জরুরি মিটিং চলছে।

অনেকদিন লতুর সঙ্গে দেখাই হয় না। কোনওকালে ননদের সঙ্গে ভাব ছিল না রেমির। ঝগড়াও নেই। সহজ একটা ঈর্ষাহীন, ভালবাসাহীন সম্পর্ক ছিল মাত্র। লতু আজকাল খুব পার্টি করে। প্রায়ই বাড়ি থাকে না। আজও নেই।

বাড়ি ফাঁকা। রেমি দোতলার সামনের বারান্দায় দাঁড়িয়ে রাস্তা দেখছিল।

দেখতে দেখতে আনমনা রেমি হঠাৎ ভীষণ চমকে উঠল। গলির মধ্যে আজকাল কয়েকটা দোকান হয়েছে। বাড়ির ফটকের উলটোদিকেই একটা পানের দোকান। এতদিন লক্ষ করেনি রেমি। দেখতে পেল সেই দোকানের সামনে রাজা দাঁড়িয়ে আছে। উদভ্রান্ত চেহারা। উর্ধ্বমুখ হয়ে তাকে অবাক চোখে দেখছে।

চোখে চোখ পড়তেই হাত তুলে রেমিকে দাঁড়াতে ইঙ্গিত করে কোথায় যেন চলে গেল খুব তাড়াতাড়ি হেঁটে।

রেমি বিবশ হয়ে গেল। রাজা কি প্রায়ই ওখানে এসে দাঁড়িয়ে থাকে আজকাল! তাকে দেখার জন্য? সে কখনও টের পায়নি তো আগে!

একটা শিহরন আর ভয় খেলা করে গেল রেমির শরীরে। তাকে যে এমনভাবে কেউ কামনা করে, এত পাগলের মতো তাকে চায় এটা ভাবলেই শিউরে ওঠে গা। কিন্তু পাগলটা এত বিপজ্জনকভাবে যদি রোজ এসে হানা দেয় তা হলে ধরা পড়ে যাবে। এ বাড়িতে আসতে বাধা নেই রাজার। অনায়াসেই আসতে পারে। সেটা দৃষ্টিকটুও হবে না। কিন্তু ওই পানের দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে হাঁ করে চেয়ে থাকাটাই অস্বাভাবিক। ও কেন করে ওরকম?

রেমি হঠাৎ শুনতে পেল ফোন বাজছে। ফোন তার ধরার কথা নয়। কিন্তু হঠাৎ তার মনে হল, ফোনটা হয়তো রাজাই করছে।

সে ঘরে এসে ফোন তুলে নিল কানে, কে বলছেন?

রেমি, আমি রাজা।

আন্দাজ করেছিলাম। কী ব্যাপার বলে তো! ওরকমভাবে বাইরে দাঁড়িয়ে ছিলে কেন?

সাধে কি আর ওভাবে দাঁড়াতে হয়? তোমার শ্বশুর আমাকে ওয়ার্নিং দিয়েছে। বাড়িতে ঢুকলে খুন করবে।

বলো কী? কেন, তুমি কী করেছ?

যা করেছি তা তো তুমি জানোই। তোমার সঙ্গে মেলামেশা।

সেটা তো উনিই করতে বলেছিলেন।

হ্যাঁ, কিন্তু উনিই আবার আইন পালটেছেন। উনি যখন যেভাবে নাচাবেন আমাদের তেমনি নাচতে হবে।

রেমি খুব ক্লান্ত বোধ করে বলল, ওঁর ছেলেও তো আমার সঙ্গে ডিভোর্স চাইছে। তুমি কথাটা ওঁকে বলেছ?

না। ওসব বলে লাভ নেই। উনি কানে তুলবেন না। মানুষটা ওর কাছে বড় কথা নয়। বড় হচ্ছে ফ্যামিলি। কুট্টিদা তোমাকে ছাড়লেও উনি তোমাকে ও-বাড়ি থেকে বেরোতে দেবেন না। দরকার হলে খুন করবেন, তবু বাড়ির বউকে অন্য পুরুষের ঘর করতে দেবেন না।

রেমি একটু দ্বিধায় পড়ে বলল, ঠিক তা নয়, রাজা। তোমার কুট্টিদা আমাকে তাড়ালেও উনি আমাকে ভীষণ ভালবাসেন। এমনকী সব বিষয়সম্পত্তি আমার নামে লিখে দিতেও চেয়েছিলেন।

ওসব বিশ্বাস কোরো না, রেমি। পালাও। পালাব? পারলে এক্ষুনি। যদি বাঁচতে চাও। তুমিই তো বলছ উনি খুন করবেন। আমাদের রিস্ক নিতে হবে।

আমি যে-কোনও রিস্ক নিতে পারি, রাজা। মরতে আমার একটুও ভয় নেই। কিন্তু তোমাকে বিপদে ফেলতে ইচ্ছে করে না।

আমার বিপদ তোমাকে না পেলে। তোমাকে না পেলে আমি মরে যাব।

রেমি একটু ম্লান হাসল। ঠোঁট কামড়ে বলল, সে তো বুঝতেই পারছি। নইলে বোকার মতো পানের দোকানে দাঁড়িয়ে থাকতে না।

গত চারদিন ধরে রোজ ঘণ্টা চারেক এই গলিতে ঘোরাঘুরি করি।

কেউ দেখে ফেলেনি তো!

না। গলির মোড়ে লাল বাড়িটায় আমার এক বন্ধু থাকে। দরকার হলে তার ঘরে ঢুকে পড়ি। বন্ধু কি সব জানে?

না জানলেও আন্দাজ করছে। আমার মুভমেন্টটা তো যথেষ্ট সন্দেহজনক।

কেন অমন করছ, রাজা? আমি এমন কিছু দুর্লভ তো নই।

এখন ভীষণ দুর্লভ। আর তুমি যত দুর্লভ হবে আমি তত পাগল হব।

প্লিজ, পাগল হোয়ো না। তুমি যদি বাড়িতে ঢুকতে সাহস না পাও তা হলে আমিই বেরোব। দেখা করব তোমার সঙ্গে।

পারবে?

রেমি হাসে, পারব না কেন? কেউ তো আমাকে আটকাচ্ছে না।

কুট্টিদা বাড়িতে নেই?

আছে। থাকলেই কী?

ওর সামনে দিয়ে বেরিয়ে আসতে পারবে?

ওমা! কী বলে রে পাগল! ও তো আমি গেলেই বাঁচে।

এখন আসতে পারবে, রেমি?

পারব।

আমি মোড়ে অপেক্ষা করি তা হলে?

না। তুমি ট্রাম ডিপোর কাছে গির্জার গলির মুখটায় থাকো। আসছি।

উঃ, বাঁচালে! তোমাকে না দেখে একদম থাকতে পারছি না।

আমিও না।

ফোনটা রেখেই রেমি বুঝতে পারল তার শেষ কথাটা সম্পূর্ণ মিথ্যে এবং বানিয়ে বলা। রাজাকে দেখে তার বেশ কয়েকটা দিন কেটে গেছে। কিন্তু সে বিন্দুমাত্র বিরহ বোধ করেনি।

রেমি নীচের ঘরে এসে দেখল, ধ্রুব নেই। ওয়ার্ডরোব খুলে রেমি শাড়ি ব্লাউজ বের করে পরতে লাগল। সামান্য প্রসাধন মাখল মুখে। চুল আঁচড়াল। যখন চটিজোড়া খুঁজছে তখন দরজায় টোকা দিয়ে ঘরে ঢোকে ধ্রুব।

ঢুকেই বলে, বেরোচ্ছ! বাঃ! এই তো উন্নতি দেখা যাচ্ছে।

রেমি জবাব দিল না। চটি পরল।

ধ্রুব তার দিকে খানিকক্ষণ চেয়ে থেকে বলল, ওই গাড়লটাকে বোলো ওভাবে এ গলিতে ঘুরঘুর করতে। কেষ্ট চৌধুরীর চোখ তো মোটে একজোড়া নয়।

রেমি থমকায়। তারপর বলে, তুমি তা হলে জানো?

শুধু আমি কেন, জগাদা হরিদা থেকে শুরু করে ঠিকে ঝি পর্যন্ত জানে।

জানে?

পানওলাটা কেষ্ট চৌধুরীর একজন ক্যাডার, আর ক্যাডার বলেই ইলিগাল কনস্ট্রাকশন করে দোকানঘরটা খুলতে পেরেছে। গাড়লটা যা ভাবছে তা নয়।

রেমি যদিও নার্ভাস বোধ করছিল, তবু বলল, বেশ তো, জেনে এখন কী করবে?

তা আমি কী জানি! তোমার শ্বশুর জানে। তাকে জিজ্ঞেস কোরো।

আমি ওর সঙ্গে দেখা করতে যাচ্ছি।

হ্যাঁ। গির্জার গলির মুখে ও দাঁড়িয়ে আছে। যাও।

তুমি আমাদের কথা শুনেছ?

সে আর শক্ত কথা কী? নীচের হলঘরে এক্সটেনশন ধরে যে কেউ শুনতে পারে। ইন ফ্যাক্ট আমি শুনলেও জগাদা শুনত। সে তোমাকে নজরে রাখছে।

রেমি অবাক হল না। এ তো সে জানেই। ঘেন্নায় মুখটা একটু কুঁচকে বলল, তোমরা কী বলল তো!

খারাপ। খুব খারাপ। এরপরও শ্বশুরকে তোমার ঘেন্না হয় না?

রেমি জবাব দিল না। মুখ ফিরিয়ে বেরিয়ে এল।

পিছন থেকে ধ্রুব বলল, রেমি, এই বাড়ি থেকে যাতে কেউ তোমার পিছু না নেয় সেজন্য আমি চেষ্টা করেছি। জগাদাকে অন্য একটা কাজে লাগিয়ে রেখেছি। তবু যদি নেয় তবে একটু কাটিয়ে দিয়ো।

পিছু নেবে?—রেমি একটু থেমে যায়।

ঠিক পিছু নেওয়ার কথা নয়। কার সঙ্গে মিট করছ সেটা দেখে চলে আসবে। কিন্তু আমার মনে হয় সেটাও উচিত নয়। তুমি বরং একটু ঘুরে-টুরে কালীঘাট পার্ক হয়ে তারপর গির্জার দিকে যাও।

রেমি মাথা নেড়ে বলল, পারব না। আমি তো চুরি করছি না। যে খুশি পিছু নিক, দেখুক।

ভয়টা তোমার নয়। রাজার। কেষ্ট চৌধুরী তোমাকে কিছু বলবে না, কিন্তু ওর পিছনে লোক লাগাবে।

রেমি পুরোটা শুনতে দাঁড়াল না। বেরিয়ে এল।

গির্জার গলির মুখে রাজা দাঁড়িয়ে ছিল। রেমিকে দেখেই তার মরা চোখ ধক করে জ্বলে উঠল।

এই! তুমি কেমন আছ?

রেমি একটু হাসবার চেষ্টা করল। মাথা নেড়ে লাজুক ভঙ্গিতে বলল, ভাল। তুমি?

আমি ভাল নেই, রেমি। দিনরাত হাঁ করে তোমার কথা ভাবছি।

অত ভাবার কী?

তুমি বোধহয় আমার কথা ভাবো না?

ভাবি। কিন্তু তোমার মতো পাগল তো নই। একটা ট্যাকসি ধরো।

কোথায় যাবে?

যেখানে নিয়ে যাবে সেখানেই যাব। এখানে নয়। চলো।

ট্যাকসিতে উঠেই একটু অসভ্যতা শুরু করেছিল রাজা। হাত চেপে ধরল। বার দুই চুমু খাওয়ার চেষ্টা করল। ওর গা জোরো রুগির মতো গরম। চোখ জ্বলজ্বলে। একটা খ্যাপামি খুব ভালরকম পেয়ে বসেছে রাজাকে। কিন্তু রেমির শালীনতা বোধ অন্যরকম। ট্যাকসিতে কি চুমু খাওয়া যায়! বিশেষত অচেনা ট্যাকসিওলা একজন পুরুষমানুষ এবং তার সামনে একটা আয়নাও রয়েছে, যা দিয়ে সে প্যাসেঞ্জারদের ভালরকম জরিপ করে।

কী হচ্ছে, রাজা?

কতকাল পরে তোমাকে এত কাছে পেয়েছি, রেমি।

চিরকালের মতোই তো পাবে। ট্যাকসিতে এসব নয়।

চলো তা হলে আমার ফ্ল্যাটে।

সেখানে কী?

আমি তোমার সবটুকু চাই। আজই। এক্ষুনি।

রেমি দাঁতে ঠোঁট কামড়াল। ক্ষতি কী? তার কোনও শারীরিক কামনা নেই এখন। কোনও ভালবাসার আবেগও কাজ করছে না। তবু ক্ষতি কী? ধ্রুব চৌধুরীরও জানা উচিত যে তার সতীলক্ষ্মী বউ আর সেরকম নেই। নষ্ট হয়েছে।

রেমি বলল, ঠিক আছে। আমি একটা টেলিফোন করব তার আগে।

টেলিফোন কেন?

দরকার আছে। প্রশ্ন কোরো না।

ট্যাকসি এক জায়গায় দাঁড় করায় রাজা। রেমি নামতে নামতে বলে, তুমি এসোনা, প্লিজ। আমি একা কথা বলব।

রাজা নড়ল না, কিন্তু সন্দিহান চোখে চেয়ে রইল।

রেমি ওষুধের দোকানে ঢুকে ফোন করল।

ধ্রুব চৌধুরী আছেন?

ওপাশ থেকে জগা বলে, আপনি কে?

জগাদা, তোমার দাদাবাবুকে ডেকে দাও। আমি রেমি।

কথা বলতে বলতেই ধ্রুব ফোন হাতে নেয়, বলল রেমি।

আমি রাজার ফ্ল্যাটে যাচ্ছি।

ও। তাতে কী?

বুঝতে পারছ না?

পারছি তো। তুমি ওর ফ্ল্যাটে যাচ্ছ। তারপর?

তারপর কী হতে পারে অনুমান করো।

কী হবে?

অনেক কিছু। যা যা হওয়া সম্ভব।

ও। তা এটা জানাতে আমাকে টেলিফোন কেন?

বাঃ, তোমাকে জানাব না?

কেন? আমি তো বাধা দিইনি কখনও।

তবে বলছ না কেন—গো অ্যাহেড?

তুমি কিন্তু চেঁচাচ্ছ, রেমি। কোনও পাবলিক প্লেস থেকে কথা বলছ না তো? তা হলে সবাই কিন্তু শুনছে।

রেমি সচেতন হয়ে দেখে, বাস্তবিকই দোকানদাব আর খদ্দেররা তার দিয়ে চেয়ে আছে। একটু লজ্জা পেয়ে সে গলা নামিয়ে বলে, তুমি তা হলে অনুমতি দিচ্ছ?

অনেকদিন আগেই দিয়েছি।

শ্বশুরমশাই শুনলে কী বলবেন?

সেটা তিনিই জানেন। কিন্তু তুমি অত অনুমতির ধার ধারছ কেন? এসব কি মেয়েরা স্বামী আর শ্বশুরকে জানিয়ে করে?

আমি জানালাম। আমি তো ভয় পাই না, তাই জানালাম।

ভয়ের কী? গো অ্যাহেড।

রেমি ফোনটা রেখে দিল।

তার আশা ছিল, রাজার ফ্ল্যাটে যাচ্ছে এ খবরটা জানিয়ে রাখলে সেখানে হয় ধ্রুব গিয়ে হাজির হবে, না হয় অন্তত জগাকে পাঠাবে। একটা কিছু হবেই। হবেই।

কিন্তু রাজার ফ্ল্যাটে কেউ বাধা দিতে আসেনি। কেউ না।

<

Shirshendu Mukhopadhyay ।। শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়