একটু মায়া কি অবশিষ্ট ছিল ওর বুকে! পাখি পুষলেও তো লোকের মায়া হয়। বোধহয় সেইরকমই কিছু হবে। রেমি তো এদের বাড়ির দাড়ের ময়না ছাড়া কিছুই নয়। অদৃশ্য এক শিকল ঠুনঠুন করে। রেমি টের পায়। চলে যেতে উড়ে যেতে বাধা নেই। তবু পারে না রেমি। শিকল। কীসের যেন শিকল।

ধ্রুব এক সর্বনাশের মুখে, এক গহ্বরের ধারে ঠেলে নিয়ে গিয়েও ফেলে দিল না শেষ অবধি। সেই নোংরা ঘর, অদ্ভুত পরিবেশ আর রাজার বিবর্ণ মুখ ভুলতে পারল না রেমি। তার বুকে উঠে আসছে বমির ভাব। হাত-পায়ে ঝিঝি ধরার মতো অবশ ভাব। উপোসি শরীর দুর্বল। মাথা বোধবুদ্ধিহীন, ফাঁকা।

ধ্রুব তার দিকে তাকিয়ে বইল কিছুক্ষণ। তারপর হঠাৎ যেমন এসেছিল তেমনি রেমির হাতটা ধরে একটা টান দিয়ে বলল, চলো।

রেমি কিছু প্রশ্ন করল না। পিছু পিছু নেমে এল। ট্যাকসিতে একটাও কথা বলল না ধ্রুব। বাড়ির দরজায় তাকে নামিয়ে দিয়ে সেই ট্যাকসিতেই কোথায় উধাও হয়ে গেল।

রেমি ঘরে এল। নীচের ঘরে। এ ঘর তার নয় আর। ধ্রুবর। চুপচাপ ঘরে কিছুক্ষণ বসে রইল রেমি। জীবনের সংকট-সময়ে সিদ্ধান্ত নিতে পারাটা ভীষণ জরুরি ব্যাপার। কিন্তু রেমি কোনওদিনই এই জরুরি ব্যাপারটা পেরে ওঠেনি।

আবছা ঘরে বহুক্ষণ বিবশ হয়ে বসে রইল সে। বুকজোড়া ভয়, উৎকণ্ঠা, দ্বিধা। মাথায় এলোমেলো হাজার চিন্তা।

বহুক্ষণ ধরে তার একটা কথাই বার বার মনে হচ্ছিল। কিছুদিনের জন্য তার কোথাও চলে যাওয়া দরকার। কাছাকাছি নয়। একটু দূরে কোথাও। আবার যদি সমুদ্রের ধারে যায় তাহলে বেশ হয়। সঙ্গে কেউ থাকবে না। এল।

যত সময় যাচ্ছিল ততই তার এই প্রয়োজনটা তীব্র হয়ে উঠছিল। ধ্রুবর কাছ থেকে কিছুদিনের জন্য তার দূরে সরে যাওয়া উচিত। শিকলটা ঠুনঠুন করে বাজবে, এই বাড়ি থেকে দূরে গিয়ে সে বোধ করবে এক আশ্চর্য বিরহ, তবু তার যাওয়া দরকার। ধ্রুবকে ফিরে পেতে হলে তাকে হারানো দরকার, নিজেরও দরকার হারিয়ে যাওয়া।

একথা সত্য, ধ্রুব তাকে ভালবাসে না। কখনও-সখনও দাঁড়ের ময়নাকে নিয়ে খেলা করেছে বটে, কিন্তু ভালবাসেনি। ভালবাসাবাসি নেই বলেই তাদের মধ্যে দাম্পত্য কলহ নেই, ভুল বোঝাবুঝি নেই, মান-অভিমান নেই, পরস্পরকে দখলের চেষ্টা নেই।

না, ভুল ভাবছে রেমি। ধ্রুবর নেই, কিন্তু তার আছে। ধ্রুবকে সে বহুবার বোঝানোর চেষ্টা করেছে। যে, তার জন্য একবুক ভালবাসা টলটল করে রেমির বুকে। কিন্তু ধ্রুব তত আঁজলা পাতল না কোনওদিন। পাতবেও না। তার পিপাসা নেই।

না, দূর, খুব দুর কোথাও তাকে যেতেই হবে। ধু ধু এক দূরত্বের ব্যবধান গড়ে তুলতে হবে।

অনেকটা জল খেয়ে রেমি শুয়ে রইল বিছানায়। একটা বাচ্চা এসেছিল তার পেটে! আজ সেকথা মনে পড়ল। না, তার রাগ হল না। চোখে জল এল। সেই ভ্রুণহত্যার মধ্যে শুধু নিষ্ঠুরতাই ছিল না, ছিল কুট সন্দেহ। এত অন্যায় এত অবিচার ওই একটিমাত্র লোক তার ওপর করেছে যা সারাজীবনে আর কেউ করে উঠতে পারবে না।

দূরে যাবে? হঠাৎ শিহরিত হয় রেমি। সে তো ইচ্ছে করলেই এক অনতিক্রম্য দূরত্ব রচনা করতে পারে ধ্রুবর সঙ্গে! ইচ্ছে করলেই পারে। আর কিছু না হোক খুঁজলে একটু বিষ সে কি এ ঘরেই পেয়ে যাবে না?

রেমি উঠল। খুঁজতে লাগল।

কিছু অচেনা ওষুধপত্র আছে। টিউবে কিছু অয়েন্টমেন্ট। যদি খেয়ে নেয় তাহলে অসুস্থ হতে পারে। মরার নিশ্চয়তা নেই।

বিকেলে রাজা এল।

তখন এক আচ্ছন্নতায় আক্রান্ত রেমি পড়ে আছে বিছানায়। পেটে খিদে মরে একটা যন্ত্রণা হচ্ছে। বুকে উথাল-পাথাল। চোখ বুজে সে নানারকম দুঃস্বপ্ন দেখছিল।

টুকটুক করে দরজায় অনেকক্ষণ শব্দ হচ্ছিল। তবু চোখ খোলেনি রেমি। ভীষণ ক্লান্ত। শব্দটা স্বপ্নে হচ্ছে, না বাস্তবে, তা বুঝতে অনেকক্ষণ সময় নিল সে। তারপর ক্ষীণ গলায় বলল, কে?

আমি রাজা। একটু আসব?

রেমি চকিতে নিজের শরীরের দিকে চেয়ে দেখল। না, শাড়ি ঠিকই জড়ানো আছে, শায়া দেখা যাচ্ছে না। তবু আর-একটু গা ঢেকে সে উঠে বসল। মাথাটা ঘুরছিল খুব।

এসো।

রাজা ঘরে আসে। মুখখানা থমথমে গম্ভীর। রেমি রাজার দিকে এক পলক চেয়েই চোখ নামিয়ে নেয়। আজ রাজার সঙ্গে তার দেওর-বউদির সম্পর্কটা তেমন সহজ নেই। ভারী লজ্জা করছিল রেমির।

রাজা বিছানার মুখোমুখি একটা চেয়ারে বসে বলল, খুব শুকনো দেখাচ্ছে তোমাকে। কিছু খাওনি বোধহয়!

রেমি মাথা নেড়ে বলল, না।

রাজা কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, আজ যা ঘটেছে সেটা এক্সট্রিম। তবে তুমি এটাকে অত সিরিয়াসলি নিয়ো না। কুট্টিদা যে পাগল তা তো এতদিনে বুঝেই গেছ। কী আর বলব।

রেমি মাথা নত করেই ছিল। সেইভাবেই নিজের করতলের দিকে চেয়ে বলল, ও আমাকে কোথায় নিয়ে গিয়েছিল জানো? ওটা কেমন জায়গা?

খুব খারাপ। আমরা ওটাকে গদাধরের আজ্ঞা বলে জানি। আর কিছু জানতে চেয়ো না। কোনও ভদ্রলোক জেনেবুঝে ওখানে নিজের বউকে নিয়ে যায় না।

তুমি তবে গিয়েছিলে কেন?

আমি! বলে একটু থমকায় রাজা। তারপর বলে, কুট্টিদার এই ঠেকটা বহুদিনের। আমাকে বারকয়েক কুট্টিদাই নিয়ে গেছে ওখানে। মাঝে মাঝে জলসা বসে। আমি গান গাইতে গেছি। আজ গিয়েছিলাম, কুট্টিদা একটা জরুরি কাজ আছে বলে অ্যাপয়েন্টমেন্ট করেছিল। গিয়ে বুঝলাম তা নয়।

ওটা কি ফুর্তি করার জায়গা?

তা ছাড়া আর কী! মধ্য কলকাতার টপ মন্তানরা ওখানে জড়ো হয় সন্ধেবেলায়। সারাদিন ফাঁকা থাকে।

আমার এত গা ঘিনঘিন করছে।

করতেই পারে। তবু তো তুমি সবটা জানো না।

আর জেনে কাজ নেই। তুমি বোসো, আমি বরং স্নান করে আসি।

আমি বসব না, বউদি। একটা কথা বলেই চলে যাব।

কী কথা?

রাজা কিছুক্ষণ ভ্রু কুঁচকে নিজের নখ দেখল। তারপর মুখ তুলে তার শ্রীময় মুখখানা ভরে একটা ভারী সুন্দর হাসি হাসল। বলল, তোমার সঙ্গে আমার সম্পর্কটা নিয়ে একটা কথা উঠেছে জানোই তো।

নতমুখী রেমি বলল, জানি। কিন্তু ওসব আজ থাক।

না, আমি সে কথা বলতে ঠিক আসিনি। অন্যদিকে আর-একটা রিলেশনও তৈরি হচ্ছে, তুমি বোধহয় তার খবর রাখো না।

কীসের রিলেশন?

কুট্টিদার সঙ্গে একজনের। মানে একটা মেয়ের।

রেমি এবার মুখ তুলল। তীব্র হয়ে উঠেছে তার চোখের দৃষ্টি। আর লজ্জা নেই, সংকোচ নেই, বরং প্রচণ্ড একটা তেজ ধক ধক করছে চোখে। তার উপোসি ক্ষীণ গলা থেকে বাঘিনীর চাপা গড়ড় হুংকার বেরিয়ে এল, বিশ্বাস করি না।

কেন করো না?

ওর নামে এর আগেও রটানো হয়েছিল। বাজে কথা।

কুট্টিদার আর সব দোষ থাকতে পারে, শুধু এই দোষটা নেই বলছ?

মেয়েদের সম্পর্কে ওর কোনও দুর্বলতা নেই।

ছিল না হয়তো। এখন হয়েছে। বিশ্বাস করো।

মেয়েটা কে?

আমি জানি না। দেখিনি।

শোনা কথা?

হ্যাঁ, কিন্তু বিশ্বাসযোগ্য। কিন্তু একথা তোমাকে বিশ্বাস করতে বলছি না এখনই। প্রমাণ পেলে বিশ্বাস কোরো। আমি আর-একটা কথা বলতে চাই।

রেমির শ্বাস ক্রমে উত্তপ্ত হয়ে উঠছিল। হাত মুঠো পাকিয়ে যাচ্ছিল আপনা থেকেই।

রাজা বলল, অনেক কষ্ট পেয়েছ এদের কাছে। এ যুগের মেয়েরা এত সহ্য করে না। কেন কষ্ট পাচ্ছ তুমি?

কী করব?

কিছু একটা করো। অন্তত করার জন্য পজিটিভলি ভাবতে শুরু করো।

তুমি বোসো। আমি স্নানটা সেরে আসি। বড় গরম লাগছে।

রাজা বসল। রেমি গিয়ে বাথরুমে জলের তলায় বিছিয়ে দিল নিজেকে। কত জল যে ঢালল মাথায় আর গায়ে তার হিসেব নেই। অনেকক্ষণ উন্মাদ-স্নানের পর একটু শীত করছিল রেমির। হাত-পা থরথর করে কাঁপছে। কিছু ভাবতে পারছিল না রেমি, কিছু বুঝতে পারছিল না। মনে হচ্ছিল আরও আরও জল ঢেলে গেলে, আরও বহুক্ষণ স্নান করলে বুঝি সব সংকট কেটে যাবে, মনের অস্থিরতা ধুয়ে যাবে।

তা হল না। তবু অনেকটা শরীরের তাপ কমল।

এলোচুলে সে এসে বসল রাজার মুখোমুখি। ধ্রুব যেসব শক্ত বই পড়ে তারই একটা নিয়ে পাতা ওলটাচ্ছিল রাজা। রেমি আসার পর বইটা রেখে দিয়ে বলল, কিছু খেয়ে এসো। তাহলে ভাল। লাগবে।

রেমি কে জানে কেন রাজি হয়ে গেল। হয়তো খেলে এত খারাপ লাগবে না।

এ বাড়িতে খাবার-দাবারের অভাব নেই এবং বাঁধাধরা সময় বলেও কিছু নেই। রেমি গিয়ে এক গ্লাস দুধ খেল রান্নাঘরে দাঁড়িয়ে। শক্ত খাবার খাওয়ার মতো রুচি নেই। দুধ খেতেও বমি পাচ্ছিল। তবু জোর করে খেল।

আশ্চর্য, বাস্তবিকই কিছুটা ভাল লাগছিল তার। লম্বা হলঘরের মতো ডাইনিং হল-এ সে কিছুক্ষণ পায়চারি করল। তারপর এক টুকরো মাছ দিয়ে এক মুষ্টি ভাতও খেয়ে নিল সে।

ঘরে আসতে রাজা ভারী সুন্দর করে হেসে বলল, তুমি যে আমার কথায় বাধ্য মেয়ের মতো খেয়ে আসবে এতটা ভাবিনি।

রেমি কথাটা গ্রাহ্য না করে বলল, তোমার কুট্টিদা সম্পর্কে কী বলছিলে যেন?

কী বলব বলল তো! যতটুকু জানি বললাম। এর বেশি জানি না।

তুমি কথাটা বিশ্বাস করো?

করি।

তোমার কুট্টিদার কি আগে কোনও প্রেম-ট্রেম ছিল?

ছিল, বউদি। তবে সেসব জানতে চাওয়া বোকামি।

রেমি একটা করুণ দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল, আমি সত্যিই বোকা।

কেন বলো তো!

আমার ধারণা ছিল, তোমার কুট্টিদা বোধহয় কখনও কোনও মেয়ের দিকে মনোযোগ দেয়নি।

এ ধারণা কী করে হল?

কী জানি কী করে! তবে আমি এ বিষয়ে এত নিশ্চিন্ত ছিলাম যে কখনও জানতেও চাই নি।

কুট্টিদার মতো সুপুরুষ আর স্মার্ট ছেলেদের প্রেম না হওয়াই তো আশ্চর্যের বিষয়।

সে আমি জানি। তবে মনে করতাম, মেয়েরা গন্ডায়-গন্ডায় ওর প্রেমে পড়লেও ও কখনও কারও প্রেমে পড়েনি। মেয়েদের সম্পর্কে এত উদাসীন।

ভুল ধারণা।

এ মেয়েটা কে জানো না তাহলে?

না। তবে খোঁজ নেব।

রেমি মাথা নেড়ে বলে, থাক গে, নিয়ো না।

কেন?

আমার তেমন ভাল লাগবে না জেনে। থাক গে।

তোমাকে আর-একটা কথা বলব।

কী গো?

দুটো মস্ত মস্ত লোক টেবিলের দুধারে বসে খুঁটি চালছে। এ ওকে মাত করার চেষ্টা করছে, ও একে। আমরা দুজন দুই খুঁটি। এটা বুঝতে পারছ?

তো! বুঝবার চেষ্টা করো। তুমি বা আমি দুজনের কেউই এ খেলায় কোনও ইমপরট্যান্ট ফ্যাক্টর নই। চাল দেওয়ার জন্য আমাদের কাজে লাগানো হচ্ছে মাত্র। এবার বুঝতে পারছ?

রেমি মৃদু একটু হেসে বলল, বেশ কথা বলো তুমি। শোনো, অবেলায় খেয়ে শরীরটা আইঢাই করছে। আমি একটু আধশোয়া হয়ে তোমার কথা শুনি? কিছু মনে কোরো না।

আরে না। শোও। আমি যাই।

তুমি যে কথাটা শেষ করোনি। শেষ করো আগে।

বলছিলাম দুজনের মাঝখানে পড়ে অকারণে কষ্ট পাচ্ছ কেন?

কী করব?

বেরিয়ে এসো।

তারপর?

তারপর আমি আছি।

তুমি!–আধশোয়া রেমি ফের উঠে বসে, আবার সেই কথা।

কথাটা কি খারাপ? অন্যায়?

তা বলিনি। বললাম যে তোমাকে-আমাকে নিয়েই এত গণ্ডগোল। আবার তো গণ্ডগোল লাগবে।

না রেমি, আসলে তুমি বাইরের গণ্ডগোলকে তেমন ভয় পাও না। তোমার মনটা এক জায়গায়। আটকে গেছে। নানা সংস্কার কাজ করছে। কিন্তু লাভ নেই। কুট্টিদা কোনওদিনই বোধ হয়–

কথাটা শেষ করল না রাজা। ভদ্রতাবশে।

কিন্তু রেমি মনে মনে বাক্যটা পূরণ করে নিল। তারপর মাথা নেড়ে বলল, আজও একটু আগে দূরে কোথাও চলে যাওয়ার কথা ভাবছিলাম। খুব ভাবছিলাম। আমার বোধ হয় ওর কাছ থেকে একটু দূরে থাকা দরকার।

ফর দি টাইম বিয়িং? তাতে লাভ নেই। চি

রকাল দূরে থাকব?

ভেবে দেখো।

ভেবেছি। চিরকাল দূরে থাকতে হলে মরতে হয়।

ওঃ বাবা। তাহলে আমার প্রস্তাব ফিরিয়ে নিচ্ছি। আর যাই করো, মরো না।

আমি মরলে খুব ক্ষতি হবে?

আর কারও না হোক আমার হবে। ভীষণ ক্ষতি হবে।

কেন? আমি তো তোমাকে কিছুই দিইনি।

দাওনি। সবাই কি দেওয়ার প্রত্যাশা করে?

বালিকার মতো সরল অকপট গলায় রেমি বলে, তুমি আমাকে ভালবাসো তা আমি খুব গভীরভাবে টের পাই। এত ভালবাসলে কেন?

এসব তো পুরনো কথা। জবাব চাও কেন?

জবাব চাইনি তো! শুধু প্রশ্ন করলাম। আমাকে কী করতে বলো তুমি এখন?

কুট্টিদার ওপর তোমার মোহ কবে কাটবে?

মোহ কি আর আছে? বুঝতে পারছি না। বোধ হয় কেটেই গেছে।

তাহলে এবার থেকে আমার কথা একটু মনে কোরো রোজ।

মনে করি তো! রোজ তোমাকে ভাবি। ভাবতে ভাল লাগে।

বানিয়ে বলছ না তো!

আমি বানাতে জানিই না।

তাহলে, শোনো। কুট্টিদা আজ গদাধরের আড্ডায় তোমাকে নিয়ে গিয়েছিল আমার হাতে তুলে দেওয়ার জন্য।

জানি। কাল সারা রাত এসব কথাই বলেছে। ও কি জেলাস?

না, মোটেই নয়। তুমি চলে গেলে ওর কিছু যায় আসে না।

তাই হবে।

এই ঘটনার পরও ওর সঙ্গে বসবাস করতে তোমার অপমান লাগবে না?

ভীষণ অপমান লাগছে। বড় জ্বালা। বড় ঘেন্না।

যদি মোহভঙ্গ হয়ে থাকে রেমি, ভাল করে ভেবে দেখো, তাহলে আমি তোমাকে একদিন নিয়ে যাব।

তাতে সব মিটে যাবে?

মনে হয় যাবে না। তবে আমরা বেঁচে যাব।

আমাকে ভাবতে একটু সময় দাও।

সময় নিশ্চয়ই দেব। আমাকেও ভাবতে হবে। এতদিন ব্যাপারটা ছিল খেলার মতো। এখন তো তা থাকছে না।

শশুরমশাই? উনি কী করবেন?

কিছু করবেন নিশ্চয়ই। জানি না।

ওঁকে তুমি ভয় করো না?

ভীষণ ভয় করি, রেমি। চিরকাল করে এসেছি।

ওঁর রি-অ্যাকশন কী হবে?

উনি আমাদের খুন করতে লোক পাঠাবেন হয় তো।

তাহলে?

সেইটেই ভেবে দেখতে হবে। কাউন্টার স্ট্র্যাটেজি।

থাক, রাজা। বিপদ ডেকে এনো না। আমার যেমন কাটছে কেটে যাবে।

রাজা থমথমে মুখ করে খানিকক্ষণ বসে রইল। তারপর বলল, আমি খুব কাপুরুষ নই, রেমি।

জানি। কিন্তু অন্যায় সাহসও ভাল নয়। ওঁর অনেক ক্ষমতা।

হ্যাঁ, সেও ঠিক। মন্ত্রিত্ব যাওয়ার পর উনি এখন আবার আগের মতো গুণ্ডাদের সর্দারি করছেন। সব খববই রাখি।

তাহলে এসব প্লান না করাই ভাল।

তুমি এভাবে শুকিয়ে যাবে?

আমি হয়তো বেশিদিন বাঁচব না। কোনও কোনও গাছ আছে, এক জায়গা থেকে উপড়ে নিয়ে অন্য জায়গায় লাগালে বাঁচে না।

তুমি বোধহয় আমার বিপদের কথা ভেবে এসব বলছ।

তা নয় গো। শুধু তুমি আমি নয়, বিপদ সকলের। অনেক কেলেঙ্কারি।

তা যা হওয়ার হয়েই গেছে। তবে চৌধুরীবাড়িতে কেলেঙ্কারির অভাব নেই। এ বাড়ির বউ মেয়ে ছেলে সকলেরই ইতিহাস আছে।

রেমি একটু হেসে বলল, তাই বলেই কি আমারও কেলেঙ্কারি করার অধিকার জন্মায়?

তা নয়। বললাম, তুমি এ ব্যাপারে পাইয়োনিয়ার নও।

রেমি কিছুক্ষণ বিবশ হয়ে চেয়ে রইল। আপনমনে একটু মাথা নাড়ল। তারপর বলল, আমি একটা জিনিস কিছুতেই বুঝতে পারি না, জানো?

কী?

তুমি কি বলতে পারো ও আমাকে কেন ভালবাসে না?

রাজা ভ্রুকুটি করল। প্রশ্নটা শুনে সে খুশি হল না। একটু বিরক্তির সঙ্গে বলল, ওসব জটিল প্রশ্নের জবাব জানি না। কুট্টিদার মধ্যে ভালবাসা-ফাসা নেই, বুঝলে! একদম নেই।

কঠিন পুরুষদের বোধহয় থাকেও না, না?

কে জানে। রাজার গলায় স্পষ্টই উদাসীনতা।

রেমি একটু বিষণ্ণ হেসে বলল, বরাবর ও আমাকে অন্য পুরুষের দিকে ঠেলে দেয়। নিজের বউকে কেউ পারে? বলো?

সেটা এতদিনে তোমার বোঝা উচিত ছিল।

কিন্তু একটা জিনিস ছিল। অন্য কোনও মেয়ের প্রতি দুর্বলতা ছিল না।

এখন হয়েছে।

মেয়েটাকে একটু দেখাবে? আমার খুব দেখতে ইচ্ছে করে সে কেমন মেয়ে।

রাজা উঠে দাঁড়াল। বলল, দেখাতে পারব কি না জানি না। চেষ্টা করব।

নিশ্চয়ই খুব সুন্দর, তাই না!

সুন্দর কি না তা দেখার চোখ কি কুট্টিদার আছে? থাকলে তোমাকেই দেখতে পেত।

আমি আর কী এমন সুন্দর!

সুন্দর নও!

বলে রাজা আচমকা—ভীষণ আচমকা হাত বাড়িয়ে খামচে ধরে রেমিকে টেনে আনল নিজের কাছে। কয়েক মুহূর্তের বিভ্রম, সম্মোহন, প্রলয়।

ঠিক সেই মুহূর্তে দরজার বাইরে অনুচ্চ গলা খাঁকারির একটা শব্দ পাওয়া গেল। দরজায় মৃদু একটু করাঘাত।

রেমি ছাড়ানোর চেষ্টা করেনি নিজেকে। গায়ে শক্তি নেই। মন অবশ। রাজা নিজেই তাকে বিছানায় বসিয়ে দিল। তারপর গিয়ে দরজা খুলল।

চৌকাঠে দাঁড়িয়ে জগা।

কী চাও, জগাদা?

বউদি খেয়েছে কি না জানতে এলাম।

খেয়েছে।

ঠিক আছে, তোমরা গল্প করো।

জগা দরজাটা আবার টেনে দিয়ে গেল।

রাজা চাপা গরগরে গলায় বলে, স্পাই! স্পাই!

রেমি একটুও উত্তেজিত হল না। মৃদু স্বরে বলল, সব সময়েই কেউ না কেউ আমাকে পাহারা দেয়, তাই না?

আর তুমি সেটা সহ্য করো। কেন করো, রেমি?

রেমি মাথা নেড়ে বলল, আর করব না। আমাকে খুব দূরে নিয়ে যেতে পারবে?

কেন পারব না?

কোথায়?

বোম্বে।

বোম্বে? সেখানে কী?

আমি কলকাতা ছেড়ে দেব। বোম্বের ফিল্ড অনেক ভাল।

রেমি একটা যেন স্বস্তির শ্বাস ফেলে বলল, ঠিক আছে।

প্রমিস, রেমি?

রেমি হাসে, প্রমিস আবার কেন? কথাটা বিশ্বাস হচ্ছে না?

হচ্ছে। তবু তোমার ওপর থেকে ধ্রুব চৌধুরীর সব হিপনোটিজম এখনও কাটেনি হয়তো।

কেটে গেছে। যাওয়ার আগে আমি শুধু সেই মেয়েটাকে একবার দেখে যেতে চাই।

কুট্টিদার প্রেমিকাকে?

হ্যাঁ। তাকে একবার চোখের দেখা না দেখে পারব না।

<

Shirshendu Mukhopadhyay ।। শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়