সব আরম্ভেরই একটা শেষ আছে, সব শেষেরই একটা আরম্ভ |

শঙ্খ-লাগা সাপ যেমন একটি আরেকটিতে লগ্ন হয়ে থাকে,
যেমন বানের মধ্যে থাকে পলি আর পলির মধ্যে বান |

কথাটা হল, কে কিভাবে দেখে, কখন কোন্ খানে দাঁড়িয়ে

ধানের মধ্যে বীজের পরম্পরায় অন্তহীন ধান ? নাকি
    কাঁধে-তোলা খাটিয়ার আগে আগে ছড়াতে ছড়াতে যাওয়া
         ভাঙানো পয়সার টোপে গাঁথা হরির লুটের খই ?

সামনে মুক্তি, না এখানেই ছেদ? ফস্ করে জ্বলে ওঠা,  না
                                 দপ্ করে নিভে যাওয়া ?
আগুনের চুম্বন, না হাওয়ার ফুত্কার ?

আমি বলি, যা হচ্ছে হোক,  যা চলছে চলুক—
দশ আঙুলের টিপছাপে একদিন জীবন সব বাকি বকেয়া
                                   উশুল করে নেবে |

আসলে ওটা একটা কথার কথা, যারপরনেই ধরতাই বুলি
এই যেমন এক সময়ে আমাদেরই একজন বলতেন

বড়বাবু বললেন, আমি বললাম,
আমি বললাম, বড়বাবু বললেন,
শেষকথা বলবেন আপনারা |
বলতে বলতে
        বলতে বলতে
                মুখে ফেনা বেরিয়ে গেল
এখন শুনছি বড়বাবুরও বড়বাবু আছে
       আরেকটু না তুললে কিচ্ছু হওয়ার নয় |


আমাদের এদিককার রাস্তাঘাটে,  মশাই
আর বলবেন না,
বছরে বারোমাস ভোঁচকানি-লাগা ক্ষিধে---
বেরোলেই পা জড়িয়ে ধরে |
আর এমন অবাধ্য, কী বলব |
যাকেই বলি, দাঁড়াও—
   সে সটান শুয়ে পড়ে |

        আর ওঠে না |

সকালবেলায় জানালার গরাদ ঠেলে ভেতরে আসে
হাসপাতালের রুগীর পোশাকে রোদ্দুর !
পাশ ফিরে দেখি
মেঝেতে মুখ থুবরে পড়ে রয়েছে সকালের কাগজ |
সেকেন্ডক্লাস ট্রামে কাল আমার হাঁটুর বয়সী একজনকে দেখে
বুকের মধ্যেটা হিম হয়ে গিয়েছিল |
চোখে একরাশ ঘুম নিয়ে
লোকটা কাজ থেকে ফিরছিল |
তার চোখের কোণ, নাকের ডগা,
লালা-ঝরানো ঠোঁট,
নখের ময়লার নীচে থেকে হাতের চেটো
সমস্তই কাগজের মতন সাদা |

কাগজটা হাত বাড়ালেই পাই |
একটুও ইচ্ছে করছে না—
কেননা বন্যায় ভেসে-যাওয়া
মৃত সন্তান বুকে আঁকড়ানো মৃত মায়ের
পাশেই দেখব

হয়তো
             তুইথুলি মুইথুলি করছে
             তিনটে ঘাটের মড়া
             একজন বলে বৃষ্টি
             তো একজন বলে খরা
             দুজনে  এ ওকে টিপছে
             তিন নম্বরকে সরা
নয়তো
             মাথায় পট্টি,  গলায় লেত্তি
             সামনে করে ভাঁড়ামি
             কাটে ফোড়ন আপনি মোড়ল
             এক ভুঁইফোড় সোয়ামী

             যার খায় নুন তার গায় গুণ
             নইলে নিমকহারামি
             যাকেই দেখে শুধায় তাকে
             বলো তো বাবা, কার আমি ?


আমি এখুনি নৌকো বানিয়ে রাস্তায় ভাসিয়ে দিতে পারি
কিংবা জল না থাকলে ধরাতে পারি আগুন |
কিন্তু এরা কেউই তাতে নাকচ হয়ে যাবে না |
মাঝখানে পর্দা পড়বে এই যা,  আর তার আড়াল থেকে
একই মানুষ শুধু একটু নামনিশান আর পোশাক বদলে
চুল কাঁচিয়ে, নয় চুল সাদা ক’রে
ঠিক পরের দৃশ্যেই আবার দোর্দণ্ডপ্রতাপে ফিরে আসবে |

হাততালি দিতে গিয়ে মাথার ভেতর হাতকড়াগুলো ঝন্ ঝন্ করে উঠছে,
দিনের আলোয় কালো দস্তানায় ঢাকা সাদা থাবা
অন্ধকারে বার করে আনছে তার ধারালো নখ
বেকার ছেলেগুলো চোখের মাথা খেয়ে
আর কিছু না পেয়ে
        কাজে-না-লাগা হাতগুলোই
               আগুনে পোড়াচ্ছে |

আকাশে মেঘ করেছে |
ধ্রুবতারা  না দেখতে পেয়ে কেউ কেউ ভরসা করছে না
             ঘরের বাইরে পা দিতে |
আমার কাছে অনেক দিনের পুরনো এক দিগ্ দর্শন যন্ত্র
                                   আমার হৃদয় |
আমি সেটা কোনো আগন্তুককে দেব বলে
কেবলি ঘর-বার  ঘর-বার করছি |


লেনিনকে আমরা দাঁড় করিয়ে রেখেছি ধর্মতলায়
ট্রামের গুমটির পাশে |
আঁস্তাকুড়ের  ভাত  একদল খুঁটে  খুঁটে খাচ্ছে
ডাস্টবিনে হাত চালিয়ে দিয়ে |

               লেনিন দেখছেন |

গ্রামের এক লোক শহরে ডাক্তার দেখিয়ে সর্বস্বান্ত হতে এসেছিল
তার আগেই তাকে সর্বস্বান্ত করে দিয়ে গেল
এক পকেটমার |

                লেনিন দেখছেন |

সন্ধের মুখে যে মেয়েটাকে একটা ট্যাক্সি এসে
তুলে নিয়ে গিয়েছিল,
সন্ধে গড়িয়ে গেলে, হাই তুলতে তুলতে
সে আবার এসে দাঁড়িয়েছে গাছতলায় |

                লেনিন দেখছেন |

দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে লেনিনেরও খুব হাই পাচ্ছিল |

হঠাৎ দেখলাম একটু নড়েচড়ে সোজা হয়ে দাঁড়ালেন |

যেদিকে তাঁর নজর, সেইদিকে তাকিয়ে দেখলাম
লাল নিশান নিয়ে একদল মজুরের এক বিশাল মিছিল আসছে |

আমার মনে হল, লেনিন যেন চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে বললেন,

শতাব্দী শেষ হয়ে আসছে---
একটু পা চালিয়ে,  ভাই,  একটু  পা চালিয়ে ||

Subhash Mukhopadhyay ।। সুভাষ মুখোপাধ্যায়