মরি মরি
    পুজোয় পাওয়া নীলাম্বরী
            উঠে তোমার গায়ে
                 আকাশে যে কী সুন্দর
                        দেখাচ্ছে মা তোমায়

কলাপাতায়  আলতা-সিঁদুর
   পাড়ে  রেখে সুয্যিঠাকুর
           ঝাঁপ  দেন  জলে

মার কপালে কাঁচপোকার টিপ
    চাঁদ  হিংসেয় জ্বলে

খোকার হাতে ছিপ
    জলের গায়ে ছবি
           ক্ষীর নদীর কূলে ব’সে
                 হাই তুলতে তুলতে খোকা
                        দেখতে পাচ্ছে সবই

কোথাও কারো ভুলে
    ছবি উঠল দুলে
           ঢেউ হারাল খেই
                  কোথাও কিচ্ছু নেই
                         সমস্তই  ভোঁ  ভাঁ

চোখের পাতায় মুড়ে
      ঘুমের মধ্যে মা তুমি দিয়েছিলে
                 স্বপ্ন  হয়তো বা

ছিপ নিয়ে গেল কোলাব্যাঙে
     মাছ নিয়ে গেল চিলে

মা,  তুমি জল পাঠাও মরা গাঙে ||



আলটপ্ কা  আশ্বিনের ঝড়ে
হঠাৎ সব
    টালমাটাল

মাথার ওপর হাঁকাচম্ কা আকাশ ভেঙে পড়ে
মাঝদরিয়ায় মাঝি ছেড়েছে হাল

গ্রামগঞ্জ শহরবাজার মাঠময়দান দিয়ে
শন শন শন সাঁই সাঁই সাঁই
বাতাস ছেটে
    আগুন মুখে নিয়ে

পায়ের নীচে বাসুকি নড়ে ওঠে

শাঁখ বাজছে শাঁখ
দূরে অদূরে ঘরেদুয়োরে
শাঁখ বাজছে শাঁখ
.    একের পর এক

কেবলি  থেকে  থেকে
আমার মা-র মতন করে
    আমার নাম ধরে
            কে  ডাকে  কে
                   আকুল আর্তনাদে

আমি যে কী করি
বাঁচালে বাঁচান
মারলে মারেন  হরি
          বলতেও  যে  বাধে

মনে  পড়ল  মায়ের  ডাকে
     ক্ষুদিরাম তো
                বলেনি মা যাই
গলায় দিয়ে ফাঁসি
বলেছিল
  মা, আসি ||



বর্গাচাষীর  মুখের হাসি
   মিলিয়ে যায়
   বিঘে দুই ভুঁই ভাগ হতে ভাগ হতে
         দুই বিঘতে.                এসে ঠেকেছে প্রায়

যে না বলবে হাঁ-জী
সে দুশমন পাজি
দল বেঁধে তার ভিটেয় ঘুঘু চরাও
ধান পাকলে
    ক্ষেতে হও সব চড়াও

হা  রে রে রে রে রে
রা  কাড়ছিস  কে রে

জোয়ানগুলো হন্যে হয়ে
ঘুরে  মরছে  কাজের জন্যে
             কারখানাতে কুলুপ

লালদীঘিতে রঙের তুরুপ
পিটিয়ে নেয় সমস্ত পিঠ
মা,  জননী  ছেঁড়া  মেঘের
             কাপড়ে  দেন গিঁট ||



নামিয়ে মুখ তাকিয়ে দেখি  এ কী
সামনে আমার স্বর্গীয় মা-র মতন অবিকল
দাঁড়িয়ে আছে  মাটিতে মা-সকল
লজ্জা ঢাকতে লজ্জা পাচ্ছে পরনে ছেঁড়া শাড়ি
চোখের কোলে জল থই থই
যতই চাইছে বাঁচতে ততই
ছেড়ে যাচ্ছে নাড়ি
শুকনো মুখ রুক্ষ চুল সর্বাঙ্গে খড়ি
দু-হাত করে খাঁ খাঁ
আঁচলে মোছা সিঁথির সিঁদুর
মাটিতে ভাঙা শাঁখা
মিথ্যে দেনমোহর সাতপাক
পোড়া কপালে বিধির মার পণ তালাক
           তালাক  পণ  তালাক

হাতেপায়ে হাতাবেড়ি
বাঁদীকে কড়া নজরে রাখে চেড়ি

চোখের নীচে ক্ষিধেয় রাত জাগার ভুসোকালি
ঠোঁটের  কোণে রক্ত গড়ায় খালি
বুকে পিঠে
দগদগে কালশিটে
সারাটা গায়ে আঁচড়ানো কামড়ানো

মাথায় তোলা দৈত্যদানো
পরোয়া করে থোড়াই
মুখোশ খুলে আজ তারাই রাজাউজিরকোটালকে দাঁড়
করায় কাঠগড়ায়
পাবে না কেউ ছাড়
কাউকে নেই ক্ষমা

কারো জননী কারো কন্যা কারো বা প্রিয়তমা
কানে আঙুল দিলেই শোনে সমস্ত ক্ষণ
রাবণের সেই চিতায়
জ্বলছে চরম অপমানের আগুন ধিকি ধিকি

মা, তুমি দেখোনি কি
দুঃখশোক বাষ্প হয়ে কীভাবে চোখ ফোটায়
সাগর থেকে
কেমন করে আকাশে মেঘ ওঠায় ||



আমার মনের মধ্যে ঝড় বয়ে চলেছে | কাকে বলি? লেখক তার মনের
কথা সহৃদয় পাঠক ছাড়া আর কাকেই বা বলবে ?  যে লোকটা সারা
জীবন ফুল কুড়িয়ে মালা গেঁথে এসেছে,  এমন দিন আসে যখন ফুল
কুড়োতে কুড়োতে তার হাঁফ ধরে | মালা গাঁথবে কী, ছুঁচে সুতো পরাতে
গিয়ে হিমসিম খায় | তখন পাঠকই তার অন্ধের যষ্টি | সে চায় পাঠক
এসে তার হাত ধরুক | সব কিছু তুলে বেছে নিজের মতন করে সাজিয়ে
নিক | থুড়ি, কবির হাত নয়— কবিতার হাত | শুধু নিজ গুণে সাজিয়ে
নেওয়া নয়, এমন কিছু করা যাতে কথায় কাজ হয়, কবির সাধ মেটে |
কবির সঙ্গে পাঠকের পিঠোপিঠি সম্পর্ক | তাকে সামনাসামনি আনা যায়
না জেনেও সেই অসম্ভবের পায়েই আজ আমি মাথা কুটে মরছি ||



হেলিকপ্টার হেলিকপ্টার
বিকট শব্দে উড়ে যাচ্ছে
মেঘের গা ফুঁড়ে

রঙিন স্বপ্ন দেখছেন কে
গদিতে হেলান দিয়ে
শেষ অঙ্কের পর্দা পড়বে
মাটিতে পা পড়ে না তবু গর্বে
নীচে তাকালে জল থই থই বন্যা
ক্ষেত জ্বলছে খরায়
চুনি কোটালের মা দাঁড়িয়ে
নেহারবানুর কন্যা
সারি সারি বন্দুকধারী
সেলাম দেয় বুলেটপ্রুফ গাড়ি
হেলিকপ্টার পায়ের ধুলো
দিল যখন দীঘায়

জানো কি মা, ঠিক তখনই বাউলগুলো
দুয়োরে এসে কী গায়—



একবার বিদায় দে মা ব’লে
ঘুরে আসা নয়
ঘুরে দাঁড়ানোর
দিন এসেছে এবার

বিদায় নেবার দিন গিয়েছে
দিন এসেছে
.          বিদায় করার

অন্ধকার থেকে আলোয়
নিয়ে যাবে ঠিক
ঐ তো সামনে সব-পেয়েছির চুড়ো
মাথায় হাত বুলিয়ে বলেছিল
সিন্দবাদ নাবিকের সেই বুড়ো

গলায় তার সাঁড়াশি পা
নামে না ? কী জ্বালা
সবার হাতে হাত মিলিয়ে
নামিয়ে দিয়ে বুড়োকে ঘাড় ধরে
শুরু হচ্ছে নতুন করে
দিনবদলের পালা ||

Subhash Mukhopadhyay ।। সুভাষ মুখোপাধ্যায়