নতজানু হয়ে কারো পদতলে বসি, ইচ্ছে করে

অকপটে সব কথা তার সাথে বলাবলি হোক।

খুলে দিই কপাটের খিল

পর্দার আড়াল, ঘন বনবীথি ছায়া, ভিজে ছায়া

নোনাধরা পুরনো পাঁচিন

দেয়ালে কামড়ে থাকা সুপ্রাচীন ঘন অন্ধকার

স্যাঁতলার নানাবিধ মুখভঙ্গী, ফাটলের দাগ

তেল ও জলের দাগ, পান পিক, পিপাসার দাগ

সব চিহ্ন, সব ছারখার

সমস্ত গোপন দুঃখ শোক 

অকপটে বলাবলি হোক।

 

আমাদের কতটুকু প্রয়োজন ছিল পৃথিবীর?

নিজস্ব জননী ছাড়া আমরা কি আর কারও সাধের সন্তান?

আর কারও প্রিয় প্রয়োজন?

সদ্ভাবে ও স্নেহে কারো ভ্রাতা?

 

আমরা অসুস্থ হলে কোনখানে খুঁজে পাব ত্রাতা?

অবশ্য এ পৃথিবীর বহু জল, মাটি, ধুলো, রোদ, বৃষ্টি, ঘাস

টেনে ছিঁড়ে লুটেপুটে আমরা করেছি ক্ষয়, অপচয় গ্রাস।

তখন ধারণা ছিল আমাদেরই করতলে ভুবনের সব চাষ-বাস।

পৃথিবীর বুকের ভিতরে

উজ্জয়িনী আরেক পৃথিবী

আমাদেরই গড়ে দিতে হবে চমৎকার।

আরেক রকম দেশ, রাজধানী, সমৃদ্ধ নগর

আটচালা, পাঠশালা, স্কুল

খালে জল, মাঠে ধান, ব্রীজ, সাঁকো, বিদ্যুৎ, বাজার

স্টেশনের ডান দিকে শিরীষ গাছের ডালে লুটোপুটি ফুল

উৎসবের মতো দিন

মন্ত্রোচ্চারণের মতো মানুষের মুগ্ধ কন্ঠস্বর

সারা ভু-মণ্ডল জুড়ে একখানি ঘর।

মাটির আঁতুড় ঘরে জন্মলগ্নে ছিল ম্লান প্রদীপের শিখা

আকাশে জ্যোৎস্নার অহমিকা।

শৈশবে ছিল না রথ

ছিল রুক্ষ, রুঢ় তেপান্তর

শৈশবেই জেনে গেছি ঝড়ে ওড়ে কতখানি খড়

ক’খানা সংসার ভাসে কোটালের বানে।

কারা ভাত খাবে বলে কারা ধান ভানে।

 

অনেক ভিখারী ছিল পথে পথে, কালো কালো হাত

চর্তুর্দিকে হাতড়ায়, যদি পায় কোনখানে সুখের সাক্ষাৎ।

অনেক ভিখারী ছিল, তারা ভিন্ন লোক

ভিন্ন ক্ষুধা, ভিন্নতর সন্ধান ও শোক

ভিন্ন প্রতিজ্ঞায় তারা বেঁধেছিল হাতে রক্তরাখী

যতক্ষণ স্বাধীনতা বাকি

ততক্ষণ রণ।

 

মৃত্যুতে মহিমাময় হয়ে গেছে তাদের জীবন।

সেই সব মৃত্যুঞ্জয়ী ভিখারীর বংশধরগণ

আজ সোফা, সিগারেট, এয়ারকুলার, সিমেন্টের

সুগন্ধী সেন্টের,

পেট্‌রোলের, ইনকাম ট্র্যাক্সের দুমুখো খাতায়

অম্লান, অপরিসীম কত সুখ পায়।

 

বহু সুখী দৃশ্যপট দেখা হল, বহু গৌরবের

মানুষও গাছের মতো কত গন্ধ ছড়ানো আকাশে

গ্রহে, উপগ্রহে, শুন্যে, মহাশুন্যে মরুভুমিতলে

কল্পনার, কৃতিত্বের সার্থকতা আর সৌরভের।

 

কত রক্তপাতময় দৃশপটও দেখা হল বিমুঢ় লজ্জায়।

হাড়ের ভিতর দিয়ে ছুটে গেল চুরি

স্বাভাবিক মানবতা তামার তারের মতো রোজই হল চুরি।

কত ট্রেন থেমে গেল অনাদৃত, অজ্ঞাত স্টেশনে।

অচরিতার্থতাবোধ প্রসব ব্যথার মতো রয়ে গেল স্থির

মানুষের চেতনার গর্ভের আঁধারে।

 

আমার সকলই আছে জামা জুতো, ছাতা, টেরিলিন

মেডেল ও মেডেলকে ঝোলাবার সরু সেফটিপিন

মাসান্তে মাসান্তে পে-প্যাকেট

তাতে কেনা হয়ে যায় গ্রীষ্মের বাতাবিলেবু, শীতের জ্যাকেট।

ভিখারীর হাত পেতে আরও কিছু পেয়ে যাই একানি দুয়ানি

বিভিন্ন দয়ালু ব্যক্তি ছুঁয়ে দেয় ছেঁড়া কাঁথাকানি।

নিজের ঘামের নুনও চেটে খাই, পরিতৃপ্ত গাল,

বাহিরে যে থাকে সে তো অসি’সার আজন্ম কাঙাল।

বাহিরে ভিখারী কিন্তু সম্রাট রয়েছে অভ্যন্তরে

লুব্ধ চুরি রক্তে খেলা করে।

উচ্চাকাঙ্খী আঙ্গুলের গাঁটে গাঁটে ছিনতায়ের লোভ

পান থেকে চুন গেলে প্রচণ্ড বিক্ষোভ।

 

যে দিকে সুন্দর আছে, সুষমামন্ডিত শিল্পলোক

যে দিকে নদীর মুখ, পর্বত চুড়ার অভ্যুদয়

ঊর্ধ্বলোক চিনে নিয়ে যে-দৃষ্টিভঙ্গিতে বীজ বনস্পতি হয়

যে সিন্দুকে ভরা আছে পূর্বপুরুষের রাত্নাগার

যে ওষ্ঠের মন্ত্রপাঠে ধ্রুবপদ বাজে বারবার

বাতাসকে গন্ধ দেয় যে সকল আত্ম ও শরীর

সব চাই, সব তার চাই

আগুনের সব শিখ, সব দগ্ধ ছাই।

 

কাকে পাপ বলে আমি জানি

কাকে পুণ্যজল বলে জানি

মুকুটের কাঁটা কয়খানি।

অভিজ্ঞতায় বৃদ্ধ, আবেগে বালক,

জাত গোত্রহীন হয়ে ভেসে আছি সময়ের নাড়ীর ভিতরে

উলঙ্গ পালক।

Purnendu Patri ।। পূর্ণেন্দু পত্রী