হেম কি একটা কথা বলিতে যাইতেছিল, কিন্তু তাহা চাপিয়া গিয়া বলিল, আমি বলচি গুণীদা, তোমার কোন ভয় নেই। এখন শরীরটা দুর্বল বলেই ও-সব মনে হচ্ছে।

বোধ হয়, তাই হবে, বলিয়া গুণী বাহিরের বৃষ্টির দিকে চাহিয়া রহিল। হেম বিষণ্ণমুখে বাহির হইয়া গেল।

সন্ধ্যার কিছু পরে দ্বারের বাহির হইতে ঘরের মধ্যে অন্ধকার দেখিয়া হেম রাগিয়া উঠিয়া ডাকিল, নন্দা, বাবুর ঘরে আলো জ্বেলে দিসনি?

গুণী ভিতর হইতে কহিল, আমি মানা করেছিলাম।

নন্দা ছুটিয়া আসিলে হেম তাহাকে একটা সেজ জ্বালিয়া আনিতে বলিয়া অন্ধকার ঘরের মধ্যে ঠাহর করিয়া গুণীর পায়ের কাছে খাটের উপর গিয়া বসিল। নন্দা ঘরে আলো জ্বালিয়া দিয়া গেলে হেম গুণীর পায়ের উপর হাত রাখিতেই, সে পা সরাইয়া লইল। হেম ব্যথা পাইয়া বলিল, তুমি কি আর আমাকে পায়ে হাত দিতে দেবে না?

গুণী বলিল, কাজ কি ভাই, তোমার গুরুর হয়ত নিষেধ থাকতে পারে।

হেম বুঝিল যে, সে আসিয়া অবধি পায়ের ধূলা লয় নাই, গুণী তাহার লক্ষ্য করিয়াছে। কিন্তু উত্তর দিতেও পারিল না, চুপ করিয়া রহিল। কিছুক্ষণ পরে বলিল, গুণীদা, আমার ওপর রাগ করেছ?

আমি কি কোনদিন তোমার উপর রাগ করেছি হেম?

হেম তৎক্ষণাৎ অনুতপ্ত হইয়া বলিল, কোনদিন না—কিন্তু আজ ও-সব কথা বলছিলে কেন?

কি কথা ভাই?

উইল করার কথা, আরো কত কি কথা,—আমি বলচি গুণীদা, তুমি ভাল হয়ে যাবে। তুমি কিছু ভয় করো না।

গুণী একটুখানি হাসিয়া বলিল, ভাল না হওয়ায় আমার কি খুব ভয় বলে তোমার মনে হয়?

হেম কাঁদ-কাঁদ হইয়া বলিল, তোমার পায়ে পড়ি, তুমি ও-সব কথা বলো না। তুমি ভাল না হলে আমি বাঁচব কি করে?

তুমি চলে গেলেই বা আমি বাঁচব কি করে? তাই, যদি ধরে রাখি, যদি যেতে না দি।

হেম ক্ষণকাল নীরব থাকিয়া বলিল, আমাকে ধরে রেখে তোমার লাভ কি?

লাভ! গুণী আর বলিতে পারিল না, নিস্তব্ধ হইয়া রহিল। বাহিরের বড় বড় বৃষ্টির ফোঁটা পটপট শব্দে সার্সীর গায়ে আঘাত করিতে লাগিল। এক-একবার দমকা হাওয়া খোলা দরজার ভিতর দিয়া আসিয়া সেজের বাতির আলো নিবাইবার উপক্রম করিতে লাগিল। নীচে চাকরদের অস্পষ্ট কোলাহল শুনা যাইতে লাগিল। তবুও দুইজনে চুপ করিয়া বসিয়া রসিল। গুণী শিশুকাল হইতে অত্যন্ত অভিমানী, অত্যন্ত সংযমী। তাহার ধৈর্যের বাঁধ সে সুদৃঢ় করিয়াই গড়িয়া তুলিয়াছিল, কিন্তু সুলোচনার শেষ আশীর্বচন সেই বাঁধের ভিত্তিমূলে সেইদিন হইতে মুষিকের মত নিরন্তর বিবর খুঁড়িয়া নদীর জল ভিতরে প্রবেশ করাইয়া বহুদূরব্যাপী ভাঙ্গন সৃষ্টি করিতেছিল, কবে কখন যে সমস্তটা ধসিয়া যাইবে তাহার স্থিরতা ছিল না।

Sarat Chandra Chattopadhyay ।। শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়