তা হলে ভাল কাজ, মন্দ কাজের অর্থ থাকে না। স্ত্রী নিজের কর্মে স্বর্গে যায়, স্বামী হয়ত জন্ম জন্ম নরক ভোগ করে—হাজার কামনা করলেও আর এক হবার উপায় থাকে না।
হেম বহুক্ষণ নিস্তব্ধ থাকিয়া আস্তে আস্তে বলিল, তবে কি সত্যিই আর মেলবার পথ থাকে না?
গুণী বলিল, না। তার আবশ্যকও থাকে না। তার চেয়ে হেম, যে মেলা সবচেয়ে বড় মেলা, যার কাছে যেতে পারলে আর কারো কাছে যেতে ইচ্ছে হবে না, অথচ সমস্ত রকমের মিলনের ইচ্ছাই আপনা -আপনি পরিপূর্ণ, সার্থক হয়ে যাবে, তুমি সেই মিলনের কামনা কর। তোমার পথ থেকে তোমাকে কেউ যেন টেনে নিয়ে না যায়; আমি কায়মনে আশীর্বাদ করি, আমাদের দেওয়া সমস্ত দুঃখ একদিন যেন তোমার সার্থক হয়।
চাঁদের আলোয় হেম দেখিতে পাইল, গুণীর চোখ দিয়া ফোঁটা ফোঁটা জল গড়াইয়া পড়িতেছে। সে পায়ের উপর মাথা ঠেকাইয়া প্রণাম করিয়া আস্তে আস্তে উঠিয়া গেল। সে উঠিয়া গেল, এমন অনেক দিনই এমনি করিয়া নিঃশব্দে উঠিয়া গিয়াছে, কিন্তু আজ যেন কেমন করিয়া গুণীর সমস্ত সংযম, সমস্ত ধৈর্যের বাঁধ সে সমূলে উৎপাটিত করিয়া দিয়া চলিয়া গিয়াছে। আজ তাহার ধিক্কারের সহিত কেবলি মনে হইতে লাগিল, যেন চিরদিনের সুযোগ অকস্মাৎ চোখের সামনে দিয়া বহিয়া গেল, হাত বাড়াইয়া ধরা হইল না। হেম তাহাকে যে কত ভালবাসে, এ কথা সে নিঃসংশয়ে জানিত। আজ তাহার মুখ হইতে স্পষ্ট করিয়া শুনিয়াও, সে কোনমতেই নিজের কথাটা বলিতে পারিল না। সুলোচনার মৃত্যু হইতেই বলি-বলি করিয়াছে, বলিতে পারে নাই। কেবলি মনে হইয়াছে, এ যেন কোন বিষধর সর্প ঘুমাইয়া আছে, হাত বাড়াইয়া স্পর্শ করিলেই বুঝি ফণা তুলিয়া উঠিয়া দাঁড়াইবে। তাই বরাবর যে ভয় তাহার হাত চাপিয়া রাখিয়াছে, আজিকার এমন রাত্রেও সেই ভয় তাহেকে হাত বাড়াইতে দিল না।
প্রত্যহ প্রাতঃস্নান করিয়া হেম প্রণাম করিতে আসিত, পরদিন আসিবামাত্রই গুণী সমস্ত সঙ্কোচ প্রাণপণে অতিক্রম করিয়া প্রশ্ন করিল, হেম, কাল তুমি বিধবা-বিবাহের কথা জিজ্ঞাসা করেছিলে কেন?
হেম বলিল, একটা খবরের কাগজে পড়ছিলাম, তাই।
গুণী বলিল, তুমি কি ওটা ভাল মনে কর?
হেম সংক্ষেপে বলিল, ছিঃ! ও কি আবার একটা বিয়ে?
গুণী প্রশ্ন করিল, কেন নয়? এক হিন্দু ছাড়া পৃথিবীর সব জাতের মধ্যেই ত বিধবা-বিবাহ আছে।
থাক গে, বলিয়া হেম বাহির হইয়া যাইতেছিল, গুণী ডাকিয়া বলিল, আর একটা কথা আছে, হেম!
হেম ফিরিয়া দাঁড়াইয়া বলিল, কি?
তোমার বয়স কত?
ষোল।
এই বয়স থেকে চিরকাল সন্ন্যাসিনী হয়ে থাকবে?
হেম মৃদু হাসিয়া বলিল, আর কি করব? যেমন কপাল! যেমন তোমাদের বুদ্ধি!
গুণী ক্ষণকাল মুখপানে চাহিয়া থাকিয়া বলিল, আর কি কোন পথ নেই, কোন উপায় নেই?
কিছু না গুণীদা, কিচ্ছু না, বলিয়া হেম বাহির হইয়া গেল।
গল্প : পথ-নির্দেশ Chapter : 5 Page: 19
- Details
- Sarat Chandra Chattopadhyay ।। শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
- Category: কবিতার বিষয়
- Read Time: 1 min
- Hits: 192