দিগম্বরী বিরক্ত হইয়া বলিলেন, আচ্ছা, আচ্ছা, তুই কাপড় ছাড়্ গে যা।
দুপুরবেলা নারায়ণী নিজের ঘরে বসিয়া বালিশের অড় সেলাই করিতেছিলেন, নেত্য ছুটিয়া আসিয়া খবর দিল, মা, সর্বনাশ হয়েচে! দিদিমা ছোটবাবুর গাছ ফেলে দিয়েছে। সে ইস্কুল থেকে এসে কাউকে বাঁচতে দেবে না! নারায়ণী সেলাই ফেলিয়া ছুটিয়া আসিয়া দেখিলেন, সত্যই গাছটি নাই।
বলিলেন, মা রামের গাছ কি হ’ল?
দিগম্বরী মুখ হাঁড়িপানা করিয়া আঙুল দিয়া দেখাইয়া বলিলেন, ওই।
নারায়ণী কাছে আসিয়া দেখিলেন, সেটি শুধু তুলিয়া ফেলা হয় নাই, মুচড়াইয়া ভাঙ্গিয়া রাখা হইয়াছে। তখনই নিঃশব্দে তুলিয়া বাহিরে ফেলিয়া দিয়া নারায়ণী ঘরে চলিয়া গেলেন।
ইস্কুল হইতে ফিরিয়া আসিয়া রাম সর্বাগ্রে তাহার গাছটি দেখিতে গিয়া একেবারে লাফাইয়া উঠিল। বই-খাতা ছুঁড়িয়া ফেলিয়া দিয়া চীৎকার করিয়া উঠিল, বৌদি, আমার গাছ?
নারায়ণী রান্নাঘর হইতে বাহিরে আসিয়া বলিলেন, বলচি, এদিকে আয়।
না, যাব না। কৈ আমার গাছ?
এদিকে আয় না, বলচি।
রাম কাছে আসিতেই তিনি হাত ধরিয়া ঘরে লইয়া গিয়া কোলের উপর বসাইয়া, মাথায় মুখে হাত বুলাইয়া বলিলেন, মঙ্গলবারে কি অশ্বত্থ-গাছ পুঁততে আছে রে?
রাম শান্ত হইয়া জিজ্ঞাসা করিল, কেন, কি হয়?
নারায়ণী হাসিয়া বলিলেন, তা হলে বাড়ির বড়বৌ মরে যায় যে!
রাম একমুহূর্তে ম্লান হইয়া গিয়া বলিল, যাঃ, মিছে কথা।
নারায়ণী হাসিমুখে বলিলেন, না রে, মিছে কথা নয়, পাঁজিতে লেখা আছে।
কৈ, পাঁজি দেখি?
নারায়ণী মনে মনে বিপদ্গ্রস্ত হইয়া অকস্মাৎ গভীর বিস্ময় প্রকাশ করিয়া বলিলেন, তুই কি ছেলে রে! মঙ্গলবার পাঁজির নাম করতেও নেই—তুই দেখবি কি রে? এ কথা যে ভোলাও জানে! আচ্ছা, ডাক তাকে।
এত বড় অজ্ঞতা পাছে ভোলার কাছে প্রকাশ হইয়া পড়ে, এই ভয়ে সে তৎক্ষণাৎ অপ্রতিভ হইয়া তাহার দুই বাহু দিয়া মাতৃসমা বড়বধূর গলা জড়াইয়া ধরিয়া বুকের মধ্যে মুখ লুকাইয়া বলিল, এ আমিও জানি। কিন্তু ফেলে দিলে আর দোষ নেই, না বৌদি?
নারায়ণী তাহার মাথাটা বুকের মধ্যে চাপিয়া ধরিয়া বলিলেন, না, আর দোষ নেই। তাঁহার চোখ দুটি জলে ভিজিয়া উঠিল। মৃদুকন্ঠে বলিলেন, হাঁ রে রাম, আমি মরে গেলে তুই কি করিস?
রাম সবেগে মাথা নাড়িয়া বলিল, যাঃ—বলতে নেই॥
নারায়ণী অলক্ষ্যে চোখের জল মুছিয়া ফেলিয়া বলিলেন, বুড়ো হলুম, মরব না রে!
এবারে রাম পরিহাস বুঝিতে পারিয়া মুখ তুলিয়া সহাস্যে বলিল, তুমি বুড়ো বুঝি? একটি দাঁতও পড়েনি, একটি চুলও পাকেনি।
নারায়ণী বলিলেন, চুল না পাকতেই আমি নদীর জলে একদিন ডুবে মরব। নাইতে যাব, আর ফিরে আসব না।
কেন বৌদি?
তোর জ্বালায়! আমার মাকে তুই দেখতে পারিস নে, দিনরাত ঝগড়া করিস, সেইদিন তোরা টের পাবি, যেদিন আমি আর ফিরব না।
গল্প : রামের সুমতি Chapter : 2 Page: 10
- Details
- Sarat Chandra Chattopadhyay ।। শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
- Category: কবিতার বিষয়
- Read Time: 1 min
- Hits: 204