দুশ্চিন্তা ঘুচলো, কিন্তু দিন দুই-তিন পড়ানোর পরেই বুঝলাম ওকে আমি পড়াবো বটে, কিন্তু আমাকেও ও পড়াতে পারে। কামাই করতে শুরু করলাম, যদি বা যাই গল্প করে কাটাই, তবু দেখা গেল পরীক্ষায় মণি প্রথম হয়েছে। মণির বাপের ছিল দেশোদ্ধারের ব্যাধি, বাড়ির কোন খবরই রাখতেন না, অত্যন্ত খুশী হয়ে আমাকে ডেকে পিঠ ঠুকে দিলেন, বললেন, আমার মতো কর্তব্যপরায়ণ লোক আর নেই এবং আমার কলেজের অর্ধেক খরচ তিনিই দেবেন। আমার কর্তব্যপরায়ণতার বিবরণ বাপের কাছে মণি কোনদিন বলেনি। এমন কি, ম্যাট্রিক পরীক্ষায় ও যখন জলপানি পেলে, তারও অর্ধেক কৃতিত্ব আমার ভাগ্যেই জুটলো। জানিনে, কি কারণে বাপের বিশ্বাস ছিল মেয়ের লেখাপড়ার বনেদ আমিই পাকা করে দিয়ে গেছি।

তার পরে?

কার পরে দাদা?

ম্যাট্রিকে স্কলারশিপ পাবার পরে মণি কি করলে?

মণি একটা আঙুল তুলে নিঃশব্দে তর্জন করে শেষে মাথা নেড়ে বললে, ও হবে না রমেন। নিজের সম্বন্ধে বলতে চাও বলো, কিন্তু আমার সম্বন্ধে না।

কিন্তু উনি যে মনিব। জানতে চাইলে কি না বলা সাজে?

মনিব আমার, তোমার নয়। আমার কাছে যখন জানতে চাইবেন আমি তার উত্তর দেবো।

এককড়ি প্রশ্ন করলে, বেশ তুমিই বলো। তোমার কাছেই জানতে চাইচি কি করলে তার পরে? কলেজে গিয়ে ভর্তি হলে?

এ কৌতূহলে লাভ কি এককড়িদা? আপনার কাজ ত চালিয়ে দিচ্ছি।

সে অস্বীকার করিনে মণি, বরঞ্চ মুক্তকণ্ঠে স্বীকার করি, আমাদের সঙ্ঘের কাজ অনেক বড় করেই এতদিন চালিয়ে এসেচ। কিন্তু আমাদের সেই সঙ্ঘের প্রয়োজন যদি তোমাতে শেষ হয়ে থাকে আর কোন একটা উপায় করে ত দিতে পারি। কিছু একটা তোমার ত করা চাই।

জীবিকার জন্য বলছেন?

ধরো তাই।

কিছুক্ষণ সকলেই চুপ করে রইলো। শেষে মণি জিজ্ঞাসা করলে, আমাকে কি আপনি আর চান না?

জলধি চায় না। সে বলে তুমি থাকলে কল্যাণ-সঙ্ঘের নাম পালটে দিতে হবে।

বুঝেচি। কিন্তু আপনি নিজে কি বলেন?
এখনও বলিনি কিছুই। জানি, জলধির অনেক দোষ, তবুও জানি স্বদেশসেবার জমা-খরচের খাতায় তার খরচ বাদেও বাকী যেটা আছে সেও অনেক। তার মতো স্বার্থত্যাগ করেছে ক’জন? কত লোকে তার মতো দুঃখ ভোগ করেছে? তাকে বাদ দিলে সঙ্ঘ আমার টিকবে না।

Sarat Chandra Chattopadhyay ।। শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়