চার
অগ্রহায়ণ মাসের শেষে নবদ্বীপে এক বড়লোকের ঘরে হেমের বিবাহ হইয়া গেল। সে দূর হইতে গুণীদাকে প্রণাম করিয়া স্বামীর ঘর করিতে চলিয়া গেল। সেখানে শ্বশুর, শ্বশ্রু, জা, ননদ, কেহই ছিল না। স্বামীর বৃদ্ধা পিতামহী এবং স্বামীর অবিবাহিত ছোট ভাই—সে কলিকাতায় কলেজে পড়ে।
কিশোরীবাবুর বয়স ছত্রিশের কাছাকাছি। তিনি বিপত্নীক হইয়া অবধি একটি ডাগর মেয়ে খুঁজিতেছিলেন, তাই হেমকে না দেখিয়াই তাঁহার পছন্দ হইয়া গেল। বিবাহের পর তিনি সুলোচনাকেও এ বাড়িতে আনিবার জন্য পীড়াপীড়ি করিতে লাগিলেন। সুলোচনা সম্মত হইয়া মেয়ের কাছে পত্র লিখাইলেন। তিনি নবদ্বীপে থাকিয়া পুণ্য সঞ্চয় করেন, এই ইচ্ছা।
হেম জবাবে লিখিল, তুমি যে বাড়িতে আছ মা, সে বাড়ির হাওয়া লাগলেও সমস্ত নবদ্বীপ উদ্ধার হয়ে যেতে পারে। ওখানে থেকেও যদি তোমার পুণ্যসঞ্চয় না হয়, বৈকুন্ঠে গেলেও হবে না। ওঁকে ছেড়ে যদি তুমি এস, আমি নিজে গিয়ে তাঁর কাছে থাকব।
মেয়েকে তিনি চিনিতেন, তাই যাইতে পারিলেন না বটে, কিন্তু মন তাঁহার কোথাকার অজানা নবদ্বীপের আশেপাশে দিবারাত্র ঘুরিয়া বেড়াইতে লাগিল।
এমনি করিয়া আরো ছয় মাস কাটিয়া গেল। একদিন তিনি আর থাকিতে না পারিয়া কি একটা উৎসবের উপলক্ষ করিয়া, নন্দাকে সঙ্গে করিয়া, স্টিমারে চড়িয়া বসিলেন। সেখানে গিয়া তিনি মেয়েকে রোগা দেখিয়া দুঃখিত হইয়া বলিলেন, কেউ নাই মা এখানে, বোধ করি, তোর যত্ন হয় না।
মেয়ে হাঁ-না একটা জবাবও দিল না।
উৎসব শেষ হইয়া গেল, তবু তাঁহার ফিরিবার গা নাই দেখিয়া একদিন হেম বলিল, আর কতদিন জামাইয়ের বাড়ি থাকবে মা? লোকে নিন্দে করবে যে!
সুলোচনা রাগিয়া উঠিয়া বলিলেন, তুই আমাকে তাড়াতে পারলেই বাঁচিস! এ তবু ত আপনার মেয়ে-জামাইয়ের বাড়ি, সেইখানেই কোন্ নিজের বাড়িতে ফিরে যাব, শুনি?
হেম কিছুক্ষণ অবাক হইয়া বসিয়া থাকিয়া বলিল, তোমার দোষ নেই মা, এ আমাদের মেয়েমানুষের স্বধর্ম। আমরা আপনার-পর একদিনেই ভুলে যাই।
দিন কাটিতে লাগিল, আবার দুর্গাপূজা ঘুরিয়া আসিল। গুণী বড় ঘটা করিয়া পূজার তত্ত্ব পাঠাইয়াছিল। সুলোচনা হেমকে আড়ালে ডাকিয়া বলিলেন, গুণী আমার ব্রাহ্ম বটে, কিন্তু এ-সব জানে।
মিষ্টান্ন প্রভৃতি পাড়ায় বিতরণ করিয়া, কাপড়-চোপড় সকলকে দেখাইয়া বলিতে লাগিলেন, আমি ঘরে নেই, তাই ছেলে আমার, বোনকে তত্ত্ব পাঠিয়েচে; এবং পূজা দেখিয়াই তিনি ঘরে ফিরিবেন, এ-কথাও সকলের কাছে প্রচার করিয়া দিলেন। তাঁহার যাওয়া সম্বন্ধে হেম সেদিন হইতে আর কোন কথা বলিত না, আজও চুপ করিয়া রহিল। সুলোচনা বুঝিতে পারিয়া মনে মনে বলিলেন, যদি কখন ভগবান দিন দেন তখন বুঝবি মা, সন্তানকে ছেড়ে যেতে মায়ের প্রাণ কি করে!
কিন্তু পূজা শেষ না হইতেই সুলোচনাকে শক্ত করিয়া ম্যালেরিয়ায় ধরিল। মাস-খানেক জ্বরভোগের পরে, একদিন হেম বলিল, আর কেন মা, বিপদে মধুসূদনকে স্মরণ করতে হয়, যদি বাঁচতে চাও গুণীদাকে ডাক দাও। বলিতে বলিতে তাহার দুই চোখ জলে ভরিয়া গেল, তার পর সেই জল ঝরঝর করিয়া ঝরিয়া পড়িতে লাগিল, সে ঊর্ধ্বমুখে স্থির হইয়া বসিয়া রহিল।
গল্প : পথ-নির্দেশ Chapter : 4 Page: 11
- Details
- Sarat Chandra Chattopadhyay ।। শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
- Category: কবিতার বিষয়
- Read Time: 1 min
- Hits: 211