জীবানন্দ। (ক্ষণেক পরে) অলকা—

ষোড়শী। আপনি আমায় ষোড়শী বলে ডাকবেন।

জীবানন্দ। আর কি অলকা হতে পার না?

ষোড়শী। না।

জীবানন্দ। কোনদিন কোন কারণেই কি—

ষোড়শী। আপনি অন্য কথা বলুন। (জীবানন্দ নীরবে রহিল, ক্ষণেক পরে) কষ্টটা কি কিছুই কমেনি?

জীবানন্দ। (ঘাড় নাড়িয়া) বোধ হয় একটু কমেছে। আচ্ছা যদি বাঁচি, তোমার কি কোন উপকার করতে পারিনে?

ষোড়শী। না, আমি সন্ন্যাসিনী—আমার নিজের কোন উপকার করা কারো সম্ভব নয়।

জীবানন্দ। আচ্ছা এমন কিছুই কি নেই, যাতে সন্ন্যাসিনীও খুশি হয়?

ষোড়শী। তা হয়ত আছে, কিন্তু সেজন্যে কেন আপনি ব্যস্ত হচ্ছেন?

জীবানন্দ। (একটু ক্ষীণ হাসিয়া) আমার ঢের দোষ আছে, কিন্তু পরের উপকার করতে ব্যস্ত হয়ে পড়ি এ দোষ আজও কেউ দেয়নি। তা ছাড়া এখন বলচি বলেই যে ভালো হয়েও বলব, তারও কোন নিশ্চয়তা নেই—এমনিই বটে! সারাজীবনে এ ছাড়া আর আমার কিছুই বোধ হয় নেই।

[ষোড়শী নীরবে তাহার কপালের ঘাম মুছাইয়া দিল]

জীবানন্দ। (হঠাৎ সেই হাতটা ধরিয়া ফেলিয়া) সন্ন্যাসিনীর কি সুখ-দুঃখ নেই? সে খুশি হয়, পৃথিবীতে এমন কি কিছুই নেই?

ষোড়শী। কিন্তু সে ত আপনার হাতের মধ্যে নয়।

জীবানন্দ। যা মানুষের হাতের মধ্যে? তেমন কিছু?

ষোড়শী। তাও আছে, কিন্তু ভালো হয়ে যদি কখনো জিজ্ঞাসা করেন তখনই জানাব।

জীবানন্দ। (তাহার হাতটাকে বুকের কাছে টানিয়া) না, না, আর ভালো হয়ে নয়—এই কঠিন অসুখের মধ্যেই আমাকে বল! মানুষকে অনেক দুঃখ দিয়েচি, আজ নিজের ব্যথার মধ্যে পরের ব্যথা, পরের আশার কথাটা একটু শুনে নিই। নিজের দুঃখের একটা সদ্গতি হোক।

[বাহিরে পদশব্দ শোনা গেল। ষোড়শী নিজের হাতটাকে ধীরে ধীরে মুক্ত করিয়া লইল]

ষোড়শী। ডাক্তারবাবু বোধ হয় এলেন।

[ডাক্তার ও এককড়ি প্রবেশ করিল। ডাক্তার ষোড়শীকে এখানে দেখিয়া একেবারে আশ্চর্য হইয়া গেলেন। কিন্তু কিছু না বলিয়া নীরবে শয্যাপ্রান্তে আসিয়া রোগ পরীক্ষা করিতে নিযুক্ত হইলেন; ষোড়শী এই সময়ে প্রস্থান করিল]

এককড়ি। যদি ভালো করতে পারেন ডাক্তারবাবু, বকশিশের কথা ছেড়েই দিন—আমরা সবাই আপনার কেনা হয়ে থাকব।

ডাক্তার। (পরীক্ষা শেষ করিয়া) অত্যাচার করে রোগ জন্মেছে। সাবধান না হলে পিলে কি লিভার পাকা অসম্ভব নয়, এবং তাতে ভয়ের কথা আছে। তবে সাবধান হলে নাও পাকতে পারে এবং তাতে ভয়ের কথাও কম। তবে এ কথা নিশ্চয় যে ওষুধ খাওয়া আবশ্যক।

জীবানন্দ। এ অবস্থায় কলকাতায় যাওয়া সম্ভব কিনা তা বলতে পারেন?

ডাক্তার। যদি যেতে পারেন তা হলেই সম্ভব, নইলে কিছুতেই সম্ভব নয়।

জীবানন্দ। এখানে থাকলে ভালো হবে কিনা বলতে পারেন?

ডাক্তার। (বিজ্ঞের মত মাথা নাড়িয়া) আজ্ঞে না হুজুর, তা বলতে পারিনে। তবে এ কথা নিশ্চয় যে এখানে থাকলেও ভালো হতে পারেন, আবার কলকাতা গিয়ে ভালো নাও হতে পারেন।

এককড়ি। হুজুরের ব্যথাটা—

ডাক্তার। এরকম ব্যথা হঠাৎ বাড়ে, আবার হঠাৎ কমে যায়। কাল সকালেই হুজুর সুস্থ হয়ে উঠতে পারেন। তবে এ কথা নিশ্চয় যে, আমাকে আবার আসতে হবে।

[এককড়ির কাছ থেকে ভিজিট লইয়া ডাক্তার প্রস্থান করিলেন জীবানন্দ। কি হবে এককড়ি?

এককড়ি। ভয় কি হুজুর, ওষুধ এল বলে! বল্লভ ডাক্তারের একশিশি মিক্‌চার খেলেই সব ভালো হয়ে যাবে!

জীবানন্দ। (ষোড়শী যে-দ্বারপথে একটু আগে বাহির হইয়া গেছে সেইদিকে উৎসুক-চোখে চাহিয়া) ওঁকে একবার ডেকে দিয়ে—

Sarat Chandra Chattopadhyay ।। শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়