ষোড়শী। (হাসিয়া) তোমার হুজুরের বিবেচনা আছে তা মানি, কিন্তু সম্প্রতি পালকি চড়বার আমার ফুরসত নেই
এককড়ি। হুজুরকে বলো আমার অনেক কাজ।

এককড়ি। ও-বেলায় কিংবা কাল সকালেও কি সময় হবে না?

ষোড়শী। না।

এককড়ি। কিন্তু হলে ভাল হতো। আরও দশজন প্রজার নালিশ আছে কিনা।

ষোড়শী। (কঠোর-স্বরে) তাঁকে বলো এককড়ি, বিচার করার মত বুদ্ধি থাকে ত তাঁর নিজের প্রজাদের করুন গে। আমি তাঁর প্রজা নই, আমার বিচার করবার জন্যে রাজার আদালত আছে।

[ষোড়শী দ্রুতপদে প্রস্থান করিল এবং এককড়ি কিছুক্ষণ স্তব্ধভাবে থাকিয়া ধীরে ধীরে চলিয়া গেল। অপর দিক দিয়া হৈম ও নির্মল প্রবেশ করিল। হৈমর হাতে পূজার উপকরণ]

হৈম। যে দয়ালু লোকটি তোমাকে সেদিন অন্ধকার রাতে বাড়ি পৌঁছে দিয়েছিলেন, সত্যি বল ত তিনি কে? তাঁকে আমি চিনেছি।

নির্মল। চিনেছ? কে বল ত তিনি?

হৈম। আমাদের ভৈরবী। কিন্তু তুমি তাঁকে পেলে কোথায়, তাই শুধু আমি ঠাউরে উঠতে পারিনি!

নির্মল। পারোনি? পেয়েছিলাম তাঁকে অনেক দূরে। তোমাদের ফকিরসাহেবের সম্বন্ধে অনেক আশ্চর্য কথা শুনে ভারী কৌতূহল হয়েছিল তাঁকে দেখবার। খুঁজে খুঁজে চলে গেলাম। নদীর পারে তাঁর আশ্রম, সেখানে গিয়ে দেখি তোমাদের ভৈরবী আছেন বসে।

হৈম। তার কারণ, ফকিরকে তিনি গুরুর মত ভক্তি-শ্রদ্ধা করেন। কিন্তু সত্যিই কি তোমাকে একেবারে হাত ধরে অন্ধকারে বাড়ি পৌঁছে দিয়ে গেলেন?

নির্মল। সত্যিই তাই। যে মুহূর্তে তিনি নিশ্চয় বুঝলেন প্রচণ্ড ঝড়জলের মধ্যে ভয়ঙ্কর অন্ধকার অজানা পথে আমি অন্ধের সমান, নারী হয়েও তিনি অসঙ্কোচে হাত বাড়িয়ে দিয়ে বললেন, আমার হাত ধরে আসুন। কিন্তু পরের জন্য এ কাজ তুমি পারতে না হৈম।

হৈম। না।

নির্মল। তা জানি। (ক্ষণেক থামিয়া) দেখ হৈম, তোমাদের দেবীর এই ভৈরবীটিকে আমি চিনতে পারিনি সত্যি, কিন্তু এটুকু নিশ্চয় বুঝেচি এঁর সম্বন্ধে বিচার করার ঠিক সাধারণ নিয়ম খাটে না। হয়, সতীত্ব জিনিসটা এঁর কাছে নিতান্তই বাহুল্য বস্তু—তোমাদের মত তার যথার্থ রূপটা ইনি চেনেন না, না হয় সুনাম-দুর্নাম এঁকে স্পর্শ পর্যন্তও করতে পারে না।

হৈম। তুমি কি সেইদিনের জমিদারের ঘটনা মনে করেই এই-সব বলচ?

নির্মল। আশ্চর্য নয়। শাস্ত্রে বলে সাত পা একসঙ্গে গেলেই বন্ধুত্ব হয়। অতবড় পথটায় ওই দুর্ভেদ্য আঁধারে একমাত্র তাঁকেই আশ্রয় করে অনেক পা গুটিগুটি একসঙ্গে গেলাম, একটি একটি করে অনেক প্রশ্নই তাঁকে জিজ্ঞাসা করলাম, কিন্তু পূর্বেও যে রহস্যে ঢাকা ছিলেন পরেও ঠিক তেমনি রহস্যেই গা ঢাকা দিয়ে মিলিয়ে গেলেন—কিছুই তাঁর হদিস পেলাম না।

হৈম। তোমার জেরাও মানলেন না, বন্ধুত্বও স্বীকার করলেন না?

নির্মল। না গো, না, কোনটাই না।

হৈম। (হাসিয়া ফেলিল) একটুও না? তোমার দিক থেকেও না?

নির্মল। এতবড় কথাটা কেবল ফাঁকি দিয়েই বার করে নিতে চাও নাকি? কিন্তু নিজেকে জানতেও যে দেরি লাগে হৈম।

হৈম। দেরি লাগুক তবু পুরুষের হয়। কিন্তু মেয়েমানুষের এমনি অভিশাপ, আমরণ নিজের অদৃষ্ট বুঝতেই তার কেটে যায়।

নির্মল। (হৈমর হাত ধরিয়া) তুমি কি পাগল হয়েছ হৈম? চল, আমরা একটু তাড়াতাড়ি যাই, হয়ত পূজোর বিলম্ব হয়ে যাবে।

[উভয়ের প্রস্থান

চতুর্থ দৃশ্য

নাটমন্দির

[গড়চণ্ডীর মন্দির ও সংলগ্ন প্রশস্ত অলিন্দ। সম্মুখে দীর্ঘ প্রাকারবেষ্টিত বিস্তীর্ণ প্রাঙ্গণ। প্রাঙ্গণে নাটমন্দিরের কিয়দংশ দেখা যাইতেছে। মন্দিরের দ্বার উন্মুক্ত। দক্ষিণদিকে প্রাঙ্গণে প্রবেশ করিবার পথ। সকালে কাঁচা রোদের আলো চারিদিকে পড়িয়াছে; মন্দিরের অলিন্দে ও প্রাঙ্গণে উপস্থিত জনার্দন রায়, শিরোমণি ঠাকুর, নির্মল বসু, ষোড়শী, হৈম এবং আরও কয়েকজন নরনারী]

Sarat Chandra Chattopadhyay ।। শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়