কথাটা এলোকেশীর ভাল লাগিল না। বলিলেন, সে ত ঠিক কথা, ও গরীবের ছেলে, ওর গরীবের মত থাকাই উচিত। তবে যদি বললে ত বলি, বড়বৌ, অমূল্যটিই তোমার কচি খোকা, আর আমার নরেনই কি বুড়ো? এক-আধ বছরের ছোট-বড়োকে আর বড় বলে না। আর ও-কি কখনও বড়োলোকের ছেলে চোখে দেখেনি গা, এইখানে এসে দেখচে? ওদের থিয়েটারের দলে কত রাজা-রাজড়ার ছেলে রয়েচে যে!

অন্নপূর্ণা অপ্রতিভ হইয়া বলিলেন, না ঠাকুরঝি, সে কথা বলিনি, আমি বলচি—

আবার কি করে বলবে বড়বৌ? আমরা বোকা বলে কি এতই বোকা, যে এ কথাটাও বুঝিনে! তবে দাদা নাকি বললেন, নরেন এইখানেই লেখাপড়া করবে, তাই আসা, নইলে আমাদেরও কি দিন চলছিল না!

অন্নপূর্ণা লজ্জায় মরিয়া গিয়া বলিলেন, ভগবান জানেন ঠাকুরঝি, আমি সে কথা বলিনি, আমি বলচি কি, এই যাতে মায়ের দুঃখ-কষ্ট ঘোচে, যাতে—

এলোকেশী বলিলেন, আচ্ছা, তাই, তাই। যা নরেন, তুই বাইরে গিয়ে বস গে, বড়লোকের ছেলের সঙ্গে মিশিস নে। বলিয়া ছেলেকে ঠেলিয়া তুলিয়া দিয়া নিজেও চলিয়া গেলেন।

অন্নপূর্ণা ঝড়ের মত বিন্দুর ঘরে ঢুকিয়া কাঁদ-কাঁদ হইয়া বলিয়া উঠিলেন, হাঁ লা, তোর জন্যে কি কুটুম-কুটম্বিতেও বন্ধ করতে হবে? কি করে চলে এলি বল ত?

বিন্দু অত্যন্ত সহজভাবে জবাব দিল, কেন বন্ধ করতে হবে দিদি, আত্মীয়-কুটুম্ব নিয়ে তুমি মনের সুখে ঘর কর, আমি ছেলে নিয়ে পালাই, এই!

পালাবি কোথায় শুনি?

বিন্দু কহিল, যাবার দিন তোমায় ঠিকানা বলে যাব, ভেবো না।

অন্নপূর্ণা বলিলেন, সে আমি জানি। যাতে পাঁচজনের কাছে মুখ দেখাতে পারব না, সে কি তুই না করেই ছাড়বি? চিরকালটা এই বৌ নিয়ে আমার হাড়মাস জ্বলেপুড়ে ছাই হয়ে গেল। বলিয়া বাহির হইয়া যাইতেছিলেন, মাধবকে ঘরে ঢুকিতে দেখিয়া আবার জ্বলিয়া উঠিলেন, না ঠাকুরপো, তোমরা আর কোথাও গিয়ে থাক গে, না হয়, ঐ বৌটিকে বিদেয় কর, আমি আর রাখতে পারব না, আজ তা পষ্ট বলে গেলুম, বলিয়া চলিয়া গেলেন।

মাধব আশ্চর্য হইয়া স্ত্রীকে জিজ্ঞাসা করিল, ব্যাপার কি?

বিন্দু বলিল, জানিনে, বড়গিন্নী বলেচে, দাও আমাদের বিদেয় করে।

মাধব আর কিছু বলিল না। টেবিলের উপর হইতে খবরের কাগজটা তুলিয়া লইয়া বহিরের ঘরে চলিয়া গেল।

Sarat Chandra Chattopadhyay ।। শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়