বিজয়া। তুই নরেনবাবুর কথা কি জেনে এলি তাই বল না?

পরেশ। সে হোথা নেই—কোথায় চলে গেছে। গোবিন্দ বলে কি জানো মা-ঠান? বলে বারো গণ্ডার—

বিজয়া। (রুক্ষস্বরে) নিয়ে যা তোর বারো গণ্ডা বাতাসা আমার সুমুখ থেকে।

[বিজয়া জানালার কাছে সরিয়া গিয়া দাঁড়াইল]

পরেশ। (ঠোঙা দুইটা হাতে করিয়া) এর বেশি যে দেয় না মা-ঠান!

বিজয়া। (একটু পরে মুখ ফিরাইয়া কহিল) পরেশ ওগুলো তুই খেগে যা।

[বলিয়া পুনরায় জানালার বাহিরে চাহিয়া রহিল]

পরেশ। (সভয়ে) সব খাবো?

বিজয়া। (মুখ না ফিরাইয়া) হাঁ, সব খেগে যা। ওতে আমার কাজ নেই।

পরেশ। এর বেশি দিলে না যে মা-ঠান! কত তারে বলনু।

বিজয়া। না দিক গে। আমি রাগ করিনি পরেশ, বাতাসা তুই নিয়ে যা—খেগে।

পরেশ। সব একলা খাব? (একটু চুপ করিয়া) কানা ভট্‌চায্যিমশায়ের কাছে গিয়ে জেনে আসব মা-ঠান?

বিজয়া। কে কানা ভট্‌চায্যিমশাই রে? কি জেনে আসবি?

পরেশ। জেনে আসব কোথায় গেছে নরেনবাবু?

[মুখ ফিরাইতেই দেখিল নরেন ঘরে প্রবেশ করিতেছে, তাহার হাতে একটি চামড়ার বাক্স। নীচে সেটা রাখিয়া দিয়া হাত তুলিয়া বিজয়াকে নমস্কার করিল]

বিজয়া। (লজ্জিত হইয়া) যা যা আর জিজ্ঞাসা করবার দরকার নেই। তুই যা!

পরেশ। (ক্ষুণ্ণস্বরে) কানা ভট্‌চায্যিমশাই তেনাদের পাশের বাড়িতেই থাকে কিনা। গোবিন্দ দোকানী বললে, নরেন্দরবাবুর খবর তিনিই জানে।

বিজয়া।(শুষ্ক হাসিয়া) আসুন বসুন। (পরেশের প্রতি) তুই এখন যা না পরেশ। ভারী তো কথা—তার আবার—সে আরেকদিন তখন জেনে আসিস না হয়। এখন যা—

[পরেশ কিছু না বুঝিয়া চলিয়া গেল]

নরেন। আপনি নরেনবাবুর খবর জানতে চান? তিনি কোথায় আছেন এই?

বিজয়া। (একটু ইতস্ততঃ করিয়া) হাঁ, তা সে একদিন জানলেই হবে।

নরেন। কেন? কোন দরকার আছে?

বিজয়া। দরকার ছাড়া কি কেউ কারো খবর রাখতে চায় না?

নরেন। কেউ কি করে না করে সে ছেড়ে দিন। কিন্তু আপনার সঙ্গে ত তার সমস্ত সম্বন্ধ চুকে গেছে। আবার কেন তার সন্ধান নিচ্ছেন? ঋণ কি এখনো সব শোধ হয়নি? (বিজয়া নীরব রহিল) যদি আরও কিছু দেনা বার হয়ে থাকে, তা হলেও আমি যতদূর জানি, তার এমন কিছু আর নেই যা থেকে সেই বাকী টাকা শোধ হতে পারে। এখন আর তার খোঁজ করা বৃথা।

বিজয়া। কে আপনাকে বললে, আমি দেনার জন্যেই তাঁর সন্ধান করছি?

নরেন। তা ছাড়া আর যে কি হতে পারে, আমি ত ভাবতে পারিনে। তিনিও আপনাকে চেনেন না, আপনিও তাঁকে চেনেন না।

বিজয়া। তিনিও আমাকে চেনেন, আমিও তাঁকে চিনি!

নরেন। তিনি আপনাকে চেনেন এ কথা সত্যি, কিন্তু আপনি তাঁকে চেনেন না।

বিজয়া। কে বললে আমি তাঁকে চিনি না?

নরেন। আমি জানি। ধরুন, আমিই যদি বলি আমার নাম নরেন, তাতেও ত আপনি না বলতে পারবেন না।

Sarat Chandra Chattopadhyay ।। শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়