এখনও থাকিয়া থাকিয়া মাসিক পত্রে প্রবন্ধ উচ্ছ্বসিত হইয়া উঠে, কি করিলে সদ্য-বিধবাকে আটকাইয়া রাখিতে পারা যায়, এবং এতদর্থে পিতামাতারই বা কর্তব্য কি! বস্তুতঃ, শুরু হইতে শেষ পর্যন্ত পুরুষের এই ভয়টাই চোখে পড়ে যে, নারীকে আটকাইয়া রাখিতে না পারিলেই সে বাহির হইবার জন্য পা তুলিয়া থাকে। কেহ বলিলেন, ‘বিশ্বাসং নৈব কর্ত্তব্যম্’, কেহ আর এক ধাপ চড়িয়া বলিলেন, ‘অঙ্কে স্থিতাপি’, কেহ বা ইহাতেও সন্তুষ্ট হইতে না পারিয়া প্রচার করিলেন, ‘দেবা ন জানন্তি’। বলা বাহুল্য, ইহাতে পূজার্হা নারীর মর্যাদা বৃদ্ধি পায় নাই। এবং পুরুষের কোন্ সংস্কারের উপর যে এতগুলা বিধি-নিষেধ ডালপালা ছড়াইয়া বড় হইয়া উঠিতে পারিয়াছে, সে সম্বন্ধেও বোধ করি দুই মত নাই।
বিধবা-বিবাহ ভাল কিংবা মন্দ, সে তর্ক তুলিব না। কিন্তু, এ বিবাহ যদি শুধু এই বলিয়াই উচিত হয় যে, অন্যথা তাহাকে সুপথে রাখা শক্ত হইবে, তাহা হইলে আমি বলি, বিধবা-বিবাহ না হওয়াই উচিত।
কিন্তু কথাটা কি সত্য? পুরুষ নির্বিচারে মানিয়া লইয়াছে, কিন্তু যাচাই করিয়া দেখিয়াছে কি, বিধবা বাহিরে আসিবার জন্য নিশিদিন উদ্যত হইয়াই থাকে কি না? কথাটা প্রচার করিবার সময়, বিশ্বাস বদ্ধমূল করিয়া লইবার সময়, একবারও সে মনে করিয়াছে কি, কি গভীর কলঙ্কের ছাপ সে নারীত্বের উপর বিনা দোষে ঢালিয়া দিতেছে? বিলাতের একজন বড় দার্শনিক বলিয়াছিলেন, দাস-ব্যবসায় যেমন ‘sum of all villainy’, বেশ্যাবৃত্তি তেমনি ‘sum of all degradation’। আমি বিদেশের কথা বলিলাম, কারণ দেশের কথা তুলিতে সাহস হয় না। দেবতাদের মত এ দেশের স্বর্গেও এঁরা থাকেন, এবং রাগ করিয়া শাপ-সম্পাত করিলে মুনি-ঋষিদের চেয়ে বড় কম ফলে না। যাই হউক, বিদেশীর কথায়, এই এতবড় হীনতার মধ্যে ডুব দিয়া পড়িবার জন্যই কি নারী অহরহ উন্মুখ হইয়া থাকে? এবং এতবড় পাশবিকতাই কি নারীর স্বাভাবিক চরিত্র? পুরুষ তাহার গায়ের জোর লইয়া বলিবে, ‘হাঁ’। নারী তাহার সঙ্কীর্ণ অভিমান লইয়া বলিবে, ‘না’। বাস্তবিক, যাচাই না করিয়া শুদ্ধ একটা কাল্পনিক উত্তর দিবার চেষ্টা করিলে তর্কই চলিতে থাকিবে। কিন্তু যাচাই করিয়া দেখিলে কি জবাব পাওয়া যায়, তাহাই দেখাইতেছি। বার-তের বৎসর পূর্বে জনৈক ভদ্রলোক এই বাংলাদেশে কুলত্যাগিনী বঙ্গরমণীর ইতিহাস সংগ্রহ করিতেছিলেন। তাহাতে বিভিন্ন জেলায় বহুসহস্র হতভাগিনীর নাম, ধাম, বয়স, জাতি, পরিচয় ও কুলত্যাগের সংক্ষিপ্ত কৈফিয়ত লিপিবদ্ধ ছিল। বইখানি গৃহদাহে ভস্মীভূত হইয়াছে—বোধ করি, ভালই হইয়াছে—সুতরাং কেহ সঠিক প্রমাণ চাহিলে দিতে পারিব না সত্য, কিন্তু ইহার আগাগোড়া কাহিনীই আমার মনে আছে। আমি হিসাব করিয়া দেখিয়া বিস্মিত হইয়া গিয়াছিলাম যে, এই হতভাগিনীদের শতকরা সত্তর জন সধবা। বাকি ত্রিশটি মাত্র বিধবা।
প্রবন্ধ : নারীর মূল্য Chapter : 1 Page: 19
- Details
- Sarat Chandra Chattopadhyay ।। শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
- Category: কবিতার বিষয়
- Read Time: 1 min
- Hits: 248