বিন্দু কহিল, তা হয়। কিন্তু আজকাল চুরুট খেতে শিখেচে যে!

মাস্টার বিস্মিত হইয়া বলিল, চুরুট খেতে শিখেচে?

পরক্ষণে নিজেই বলিল, আশ্চর্য নয়, ছেলেরা সমস্তই দেখাদেখি শেখে।

কার দেখে শিখেচে?

মাস্টার চুপ করিয়া রহিল। বিন্দু বলিল, ওর বাবাকে ও-কথা জানাবেন।

মাস্টার মাথা নাড়িয়া বলিল, এই দেখুন না, আজ পাঁচ-সাতদিনের কথা, ইস্কুলের পথে এক উড়ে মালীর বাগানে ঢুকে তার অসময়ের আম পেড়ে, গাছ ভেঙ্গে, তাকে মারধর করে এক কান্ড করেছে।

বিন্দু রুদ্ধ-নিশ্বাসে বলিল, তারপর?

উড়ে হেডমাস্টারকে বলে দেয়, তিনি দশ টাকা জরিমানা করিয়া তাকে তা দিয়ে শান্ত করেচেন।

বিন্দু বিশ্বাস করিতে পারিল না। বলিল, আমার অমূল্য ছিল? সে টাকা পাবে কোথায়?

মাস্টার কহিল, তা জানি না, কিন্তু সেও ছিল। এ-বাড়ির নরেনবাবুও ছিল, আরও তিন-চারজন ইস্কুলের বদমাস ছেলে ছিল। এই কথা আমি হেডমাস্টার মশায়ের কাছে শুনেচি।

বিন্দু বলিল, টাকাও আদায় হয়ে গেছে?

আজ্ঞে হাঁ, তাও শুনেচি।

আচ্ছা—আপনি যান। বলিয়া বিন্দু সেইখানেই বসিয়া রহিল। তার মুখ দিয়া শুধু অস্ফুটে বাহির হইল, আমাকে না জানিয়ে টাকা দিলে, এত সাহস এ বাড়িতে কার? একে তাহার মন খারাপ, তাহাতে দিদির সহিত কথাবার্তা বন্ধ, তাহার উপর এই সংবাদ বিন্দুকে হিতাহিতজ্ঞানশূন্য করিয়া তুলিল।

সে উঠিয়া গিয়া রান্নাঘরে ঢুকিল। অন্নপূর্ণা রাত্রির জন্য তরকারি কুটিতেছিলেন, মুখ তুলিয়া ছোটবৌয়ের মেঘাচ্ছন্ন মুখের দিকে চাহিয়া দেখিলেন।

বিন্দু কহিল, দিদি, এর মধ্যে অমূল্যকে টাকা দিয়েচ?

অন্নপূর্ণা ঠিক এই আশঙ্কাই করিতেছিলেন, ভয়ে তাঁহার গলা কাঠ হইয়া গেল; মৃদুস্বরে বলিলেন, কে বললে?

বিন্দু বলিল, সেটা দরকারী কথা নয়—দরকারী কথা, সেই বা কি বলে নিলে, আর তুমিই বা কি বলে দিলে?

অন্নপূর্ণা নিস্তব্ধ হইয়া রহিলেন।

বিন্দু বলিল, তুমি চাও না যে, আমি তাকে শাসন করি, সেইজন্যই আমাকে লুকিয়েচ। অমূল্য আর যাই করুক, মিথ্যে কথা গুরুজনের কাছে বলবে না, তুমি জেনেশুনে দিয়েচ, সত্যি কি না?

অন্নপূর্ণা আস্তে আস্তে বলিলেন, সত্যি, কিন্তু এইবারটি তাকে মাপ কর বোন, আমি মাপ চাচ্ছি।

বিন্দুর বুকের ভিতর পুড়িয়া যাইতেছিল, বলিল, একটিবার! আজ থেকে চিরকালের জন্যই মাপ করলুম। আর বলব না। আর কথা ক’ব না। সে যে এমনি করে চোখের সামনে একটু একটু করে উচ্ছন্ন যাবে, তা সইতে পারব না—তার চেয়ে একেবারে যাক। কিন্তু তোমার কি আস্পর্ধা!

Sarat Chandra Chattopadhyay ।। শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়