ডায়েক যুবকেরা এবং আমাজনের পাশীরা যুদ্ধে বীরত্ব দেখাইতে না পারিলে বিবাহ করিতে পায় না। নর-মাংসাহারী কারিব জাতিরা পুরুষ মারিয়া খাইতে পারে, কিন্তু স্ত্রীলোকের মাংস খাইতে পায় না। আরবদেশে শেখেরা স্ত্রীলোকের সুমুখে দাঁড়াইয়া তীব্র চাবুকের আঘাত দাঁত বাহির করিয়া সহ্য করিতে না পারিলে যুবতীর হৃদয় অধিকার করিতে পারে না, এবং আরো কয়েকটা জাতির মধ্যে যথা সুমাত্রা-দ্বীপের বাটা প্রদেশে, আফ্রিকার সুবর্ণ উপকূলের নিগ্রোদের মধ্যে, আমেরিকার পেরুর অসভ্য জাতির মধ্যে এবং আরও কয়েকটা আদিম জাতির মধ্যে, বোধ করি আমাদের দেশের টোডাদের মধ্যেও সম্পত্তির উত্তরাধিকার রমণীর দিক দিয়াই হয়, পুরুষের দিক দিয়া হয় না। এ-সকল উদাহরণ থাকা সত্ত্বেও রমণীরা চিরদিন যে নিপীড়িত হইয়াই আসিতেছে, তাহা সহস্র প্রকারের উদাহরণ দিয়া প্রমাণ করিতে পারা যায়। রমণীরা যে সম্পত্তির মধ্যেই পরিগণিত হইত, তাহা ইতিপূর্বে অনেক প্রকারে বলিয়াছি, এবং এইজন্যই সম্পত্তির উত্তরাধিকার নারীর দিক দিয়াই আসিয়াছিল। একটা স্ত্রীকে লইয়া চার-পাঁচবারেরও অধিক কাড়াকাড়ি হইয়া যাইত, সুতরাং তাহার গর্ভের সন্তান যে কোন্‌ বংশের তাহা স্থির করিবার উপায় ছিল না; এই হেতুই নিজের স্ত্রীর সন্তান বিষয় পাইত না, বিষয় পাইত ভগিনীর সন্তান। তাহাকে লইয়াও যে কাড়াকাড়ি হইত না তাহা নহে, কিন্তু হাজার কাড়াকাড়ি হইয়া গেলেও ভগিনীটি যে অন্ততঃ নিজের বংশের এবং তাহার গর্ভের সন্তান যে কতকটা নিজের বংশেরই হইবে সে বিষয়ে তাহারা নিঃসন্দেহ ছিল। এই হেতু ভাগিনেয় বিষয় পাইত, পুত্র পাইত না। বিষয় যেই পাক, উত্তরাধিকার স্থির করিত পুরুষেরা, নারীর তাহাতে কিছুমাত্র হাত ছিল না। মানুষের বুদ্ধির তারতম্য-হিসাবে ছাগলের গলা ডানদিক ঘেঁষিয়াই কাটা হউক, কিংবা বাঁ দিক ঘেঁষিয়াই হউক, ছাগলের ভালোমন্দ তাহাতে নির্দিষ্ট হয় না। বোধ করি এই কারণেই টাইলার সাহেব সুবর্ণ উপকূলের নিগ্রোদের সম্বন্ধে ইঙ্গিত করিয়া গিয়াছেন যে, বাহির হইতে নারীর অবস্থা ‘officially superior’ দেখাইলেও ‘practically very inferior’. আমার মনে হয়, সব জাতির মধ্যেই এই ইঙ্গিত খাটে। Crawley সাহেব সম্প্রতি তাঁহার Mystic Rose গ্রন্থে নারীর উন্নত অবস্থা সম্বন্ধে পাপুয়ানদের কথা তুলিয়া এই যে একটা তর্ক উত্থাপন করিয়াছেন যে, ইহাদের নারী-নির্যাতন করা সম্বন্ধে যথেষ্ট দুর্নাম থাকিলেও, এই যে একটা প্রথা আছে, নারীরাই স্বামী মনোনীত করে এবং বিবাহের প্রস্তাব তাহারাই করিতে পারে, পুরুষে পারে না, এই প্রথাটাই তাহাদিগের অবস্থা যথেষ্ট উন্নত করিয়া রাখিয়াছে। কথাটা বাহির হইতে মন্দ না শুনাইলেও বিপক্ষে বলিবারও বিস্তর আছে। প্রথম এই যে মনোনীত করে বলিয়াই যে পুরুষের কাছে নিপীড়িত হয় না, তাহার কোন সঙ্গত হেতু নাই। যাহাদের মধ্যে দাম্পত্য প্রণয়ের কিছুমাত্র ধারণা নাই, যাহারা কথায় কথায় স্ত্রী-হত্যা করে তাহাদের মধ্যে নারীর এই একটুখানি ক্ষমতা পরিশেষে তাহাদিগের যে বিশেষ কোন কাজে আসে বলিয়া মনে হয় না।

Sarat Chandra Chattopadhyay ।। শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়