সাগর। কিন্তু তারাই কি মানুষ? আমরা তাঁর ছেলে—আমাদের অন্তরের বিশ্বাসের চেয়ে কি তাদের বাইরের বিচারটাই বড় হবে ফকিরসাহেব? তাদের কি আমরা চিনিনে? একদিন যখন আমাদের সর্বস্ব কেড়ে নিলে তারা, সেও যেমন সত্যি-পাওনার দাবীতে, আবার জেলে যখন দিলে সেও তেমনি সত্যি-সাক্ষীর জোরে।
ফকির। সে আমি জানি।
সাগর। কিন্তু সব কথা ত জানো না। খুড়ো-ভাইপোয় জেল খেটে ফিরে এসে দাঁড়ালাম। বললাম, মা, আমরা যে মরি। মা রাগ করে বললেন, তোরা ডাকাত, তোদের মরাই ভালো। অভিমানে ঘরে ফিরে গেলাম। খুড়ো বললে, ভগবান! গরীবকে বিশ্বাস করতে কেউ নেই। পরের দিন সকালবেলা মা আমাদের ডেকে পাঠিয়ে বললেন, তোদের কাছে আমি মস্ত অপরাধ করেছি বাবা, আমাকে তোরা ক্ষমা কর্। তোদের কেউ বিশ্বাস না করুক আমি বিশ্বাস করব। এখনো বিঘে-কুড়ি জমি আমার আছে, তাই তোরা ভাগ করে নে। চণ্ডীর খাজনা তোরা যা ইচ্ছে দিস, কিন্তু অসৎ পথে কখনো পা দিবিনে, এই আমার শর্ত।
ফকির। কিন্তু লোকে যে বলে—
সাগর। বলুক। কিন্তু মা জানলেই হলো সে বিশ্বাস আমরা কখনো ভাঙ্গিনি। জানো ফকিরসাহেব, আমাদের জন্যেই এককড়ি তাঁর শত্রু, আমাদের জন্যেই রায়মশায় তাঁর দুশমন। অথচ, তারা জানেও না কার দয়ায় আজও তারা বেঁচে আছে।
ফকির। কিন্তু আমাকে তোরা ধরে আনলি কেন?
সাগর। কেন? শুনেছি, মুসলমান হয়েও তুমি তাঁর গুরুর চেয়ে বড়, তোমার নিষেধ ছাড়া মাকে কেউ আটকাতে পারবে না।
ফকির। কিন্তু এতবড় অন্যায় নিষেধ আমি কিসের জন্যে করব সাগর?
সাগর। করবে মানুষের ভালর জন্যে।
ফকির। কিন্তু ষোড়শী ঘরে নেই। বেলা যায়, আমিও ত আর অপেক্ষা করতে পারি নে। এখন আমি চললুম।
সাগর। পারবে না থাকতে? করবে না নিষেধ? কিন্তু ফল তার ভাল হবে না।
ফকির। এ-সব কথা মুখেও এনো না সাগর।
সাগর। মা-ও বলেন ও-কথা মুখে আনিস নে সাগর। বেশ মুখে আর আনব না—আমাদের মনের মধ্যেই থাক।
[ফকিরের প্রস্থান
সাগর। সন্ন্যাসী ফকির তুমি, জানো না ডাকাতের বুকের জ্বালা। আমাদের সব গেছে, এর ওপর মা-ও যদি ছেড়ে যায় আমরা বাকী কিছুই রাখব না।
[প্রস্থান
[নির্মল ও ষোড়শীর প্রবেশ]
ষোড়শী। ডেকে নিয়ে এলাম সাধে! ছি, ছি, কি দাঁড়িয়ে যা তা শুনছিলেন বলুন ত! দেবীর মন্দিরে, তার উঠানের মাঝখানে জটলা করে কতকগুলো কাপুরুষ মিলে বিচারের ছলনায় দুজন অসহায় স্ত্রীলোকের কুৎসা রটনা করচে, —তাও আবার একজন মৃত, আর একজন অনুপস্থিত। আসুন আমার ঘরে।
[দুয়ারে আসন পাতা ছিল, নির্মলকে সমাদর করিয়া তাহাতে বসাইয়া ষোড়শী নিজে অদূরে উপবেশন করিল]
ষোড়শী। আপনি নাকি বলেছেন আমার মামলা-মকদ্দমার সমস্ত ভার নেবেন। এ কি সত্যি?
নির্মল। হাঁ, সত্যি।
ষোড়শী। কিন্তু কেন নেবেন?
নির্মল। বোধ হয় আপনার প্রতি অত্যাচার হচ্চে বলে।
ষোড়শী। কিন্তু আর কিছু বোধ করেন না ত? (এই বলিয়া সে মুচকিয়া হাসিল) থাক, সব কথার যে জবাব দিতেই হবে এমন কিছু শাস্ত্রের অনুশাসন নেই। বিশেষ করে এই কূট-কচালে শাস্ত্রের, না? আচ্ছা সে যাক। মকদ্দমার ভার যেন নিলেন, কিন্তু যদি হারি তখন ভার কে নেবে? তখন পেছোবেন না ত?
নির্মল। না, তখনও না।
ষোড়শী। ইস! পরোপকারের কি ঘটা! (হাসিয়া) আমি কিন্তু হৈম হলে এইসব পরোপকার-বৃত্তি ঘুচিয়ে দিতাম। অত ভালমানুষই নই—আমার কাছে ফাঁকি চলত না। রাত্রি-দিন চোখে চোখে রেখে দিতাম।
নাটক : ষোড়শী Chapter : 2 Page: 34
- Details
- Sarat Chandra Chattopadhyay ।। শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
- Category: কবিতার বিষয়
- Read Time: 1 min
- Hits: 181